কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে শরয়ী রূপরেখা

Spread the love



~ আমরা কেন কবিতা লিখি?
~ কেন আমরা কাব্যের জগতে পদচারণা করি?
~ কেন আমরা কাব্যসাহিত্যের জন্য
   নতুন একটি প্লাটফর্মে একত্রিত হই ?

      আমাদের মনে রাখা ভালো, আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যচর্চা শুরু হওয়ার অনেক আগ থেকেই মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়েছে ছন্দবদ্ধ বাক্য ও সুন্দর সাজানো-গোছানো কথা। এটা ঐতিহাসিক সত্য, ভাষা ও সাহিত্যজগৎ কাব্য ও ছন্দ নিয়েই শুরু করেছিল তার যাত্রা। কবিতাই ছিল মানুষের সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম।

      পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকে সব যুগেই কাব্যসাহিত্য সমাদৃত ছিল। প্রত্যেক যুগেই কবিরা তাদের কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ সম্প্রদায়, সমাজ, দেশ ও জাতির গৌরবগাঁথা। কবিতার ময়দান সবসময় ছিল প্রতিযোগিতামূলক। কবিদের মধ্যে যিনি যত বেশি উন্নতমানের কবিতা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনিই হয়েছেন ততবেশি সমাদৃত।

     আরবদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-বাস্তবতা, আশা-আনন্দ, শত্রুতা-মিত্রতার বাহন ছিল এই কবিতা ও তাদের প্রজ্ঞামূলক কাব্যসাহিত্য। কবিতা ছিল তাদের ইতিহাস ও বিজ্ঞান, তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এককথায় তৎকালীন আরবে কবি ও কবিতা বহুল প্রচলিত ও চর্চিত একটা বিষয় ছিল। আরবের মানুষের মন-মনন, আরবের পথ-প্রান্তর কবি ও কবিতার দ্বারা আবৃত ছিলো মেঘমালার মতো।

     ইসলামের প্রাকপ্রাথমিক যুগে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই ধরনীতে শুভাগমন করেছিলেন তখন ছিলো আরবি কাব্য-সাহিত্যের সোনালি যুগ। বিশ্ববিখ্যাত কবিরা তখন প্রতিযোগিতার ময়দানে অবতীর্ণ হতেন আরবের প্রখ্যাত ‘ওকাজ’ মেলায়। যার কবিতা ওই মেলায় শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো তাকে ‘বছরের সেরা মানুষ’ উপাধিতে ভূষিত করা হতো। আর যেই কবিতার কারণে তিনি ‘বছরের সেরা মানুষ’ উপাধিতে ভূষিত হতেন ওই কবিতা কাপড়ের উপর সোনালি রঙের কালি দিয়ে লিখে দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাবান স্থান বাইতুল্লাহর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। যাকে বলা হতো “মুয়াল্লাকাত” বা ঝুলন্ত কবিতা। বিশ্বসাহিত্যে আজও ‘সাবয়ে মুয়াল্লাকাত’ বা ‘ঝুলন্ত কবিতা সপ্তক’ সবিশেষ প্রসিদ্ধ।

     অবাক করার মত বিষয় হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যখন আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত পবিত্র কুরআন শরীফ অবতীর্ণ হলো তখন কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাসাহিত্য ও উপমা রস আরবের সকল সাহিত্যকে ম্লান করে দিলো। সবার উপরে স্থান করে নিলো মহাপবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন। প্রথমদিকে যেসব কবি ইসলাম গ্রহণ করেন তারা ছিলেন কুরআনি সাহিত্য, তার ভাবগাম্ভীর্য ও রচনাশৈলীতে বিভোর।

(২)

     আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতের জিজ্ঞাসার জবাব নিয়ে এসেছেন। ইসলাম যে মানুষের বাহ্যিক ও আত্মিক উভয় অঙ্গনের খোরাক দিতে সক্ষম তার উদাহরণ পেশ করেছেন সবক্ষেত্রে। কাব্য-সাহিত্যেও রয়েছে এর উজ্জ্বল নিদর্শন ।

     নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের কাব্যসাহিত্য নিয়ে আছে আদিগন্ত বিস্তীর্ণ কথকতা। যা নাতিদীর্ঘ ও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। নবীজীসহ সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ও সাহিত্যমনস্ক। কবিতার ক্ষেত্রে রাসূলের সাহাবিখ্যাত তিন সাহাবী হজরত হাসসান ইবনে সাবিত, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব ইবনে মালিক (রা) এর পারঙ্গমতা তো সাহিত্য মহলে আজও সুবিদিত।

    আমাদের ইসলামের ইতিহাসে প্রধান চার খলিফার তিনজনই সাহিত্যালয়ে ঝলমলে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী তাদের প্রত্যেকেরই আছে আলাদা আলাদা কবিতা। এতকিছুর পরেও আমাদের সমাজের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মনে করেন ইসলাম ধর্মে নাকি কবিতা নাজায়েয ও হারাম। এই ধর্মে নাকি কবিতা ও কাব্যসাহিত্যের কোন আবেদনই নেই !

       সত্য কথা হলো, ইসলাম আসার কারণে কবিতার আবেদন ফুরায়নি বা ইসলাম কবিতাকে নাজায়েজও ফতোয়া দেয়নি বরং ইসলাম কখনো কখনো বাতিলের বিরুদ্ধে ও অপশক্তিকে রুখে দেয়ার জন্য কবিকে কবিতা লিখতে উৎসাহিত করেছে আর কবিতাকে শক্ত গলায় পাঠ করতে বলেছে। তবে হ্যাঁ, কবিতা যদি নগ্নতা, বেহায়পনা ও অশ্লীলতার পাঠ দেয় তাহলে ইসলাম সেই কবিতাকে শুধু নিষিদ্ধই করেনি বরং সমাজ থেকে চিরতরে মুছে ফেলার আদেশও দিয়েছে।

      কবিতার নামে যদি তাওহিদকে আঘাত করা হয়, কবিতার নামে যদি একাত্ববোধকে কলঙ্কিত করা হয়; তখন সেই কবি ও কবিতাকে উপড়ে ফেলার হুকুম দিয়েছে ইসলাম। আসলে ইসলাম চায় না কবিতার নামে কেউ নগ্নতা বিস্তার করুক , কবিতার নামে কেউ একাত্ববোধ নষ্ট করুক। সমাজের ছড়াক নষ্টামি। যুবসমাজের চরিত্র করুক কলুষিত।

      আমরা অনেকেই কাব্য ও কবিতাকে বাঁকা এঙ্গেলে দেখি ! কাব্যের যথাযথ মূল্যায়ন ও সমাদর করিনা ! আপনার আমার মনে রাখা উচিত, কাব্য কোন সাধারণ জিনিস নয়। কাব্য একটি উন্নত জাতির সুস্থ সংস্কৃতি ও বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার বাহন। কাব্যে রয়েছে বিপ্লবের অসম শক্তি ! কখনো কখনো হৃদয়স্পর্শী একটি কাব্যই মানুষের জীবনে এনে দেয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মানুষকে নিয়ে যায় সফলতার পথে, আরোহন করায় উন্নতির উচ্চসোপানে !

(৩)

     এবার আসুন আমরা কবিতার শরয়ী রূপরেখা নিয়ে কিছুটা পর্যালোচনা করি।কবিতার ব্যাপারে কুরআনুল কারীম ও হাদিসে নববীতে বেশ কিছু নির্দেশনা দেখা যায় যার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি কবিতা জায়েজ নাকি নাজায়েজ ? চট করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটি আয়াত বা হাদিস দেখিয়ে কবিতার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান বলে দেয়া মোটেও কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

      আমরা এই প্রবন্ধে কবিতার ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবী ও আমাদের আকাবির আসলাফের বিস্তারিত অভিমত উল্লেখ করবো যার দ্বারা বোঝা যাবে অভিযোগকারীদের দাবি সঠিক নাকি ভুল !!

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ‏:‏ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم‏:‏ الشِّعْرُ بِمَنْزِلَةِ الْكَلاَمِ، حَسَنُهُ كَحَسَنِ الْكَلامِ، وَقَبِيحُهُ كَقَبِيحِ الْكَلامِ‏.

     ” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : কবিতাও কথার মতো। রুচিসম্মত কবিতা উত্তম কথাতুল্য এবং কুরুচিপূর্ণ কবিতা কুরুচিপূর্ণ কথাতুল্য। (১)

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، أَنَّهَا كَانَتْ تَقُولُ‏:‏ الشِّعْرُ مِنْهُ حَسَنٌ وَمِنْهُ قَبِيحٌ، خُذْ بِالْحَسَنِ وَدَعِ الْقَبِيحَ، وَلَقَدْ رويْتُ مِنْ شِعْرِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ أَشْعَارًا، مِنْهَا الْقَصِيدَةُ فِيهَا أَرْبَعُونَ بَيْتًا، وَدُونَ ذَلِكَ‏.

      ” হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলতেন, কবিতার মধ্যে কতগুলো ভালো এবং কতগুলো নিকৃষ্ট পর্যায়ের। তুমি তার ভালোটা গ্রহণ করো এবং নিকৃষ্টটা পরিহার করো। আমার কাছে কা’ব ইবনে মালেক (রা) এর এমন কবিতাও বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যকার একটি কাসীদায় চল্লিশ বা তার কিছু কম সংখ্যক চরণ ছিলো। (২)

عَنْ خَالِدٍ ابْن كَيْسَانَ قَالَ‏:‏ كُنْتُ عِنْدَ ابْنِ عُمَرَ، فَوَقَفَ عَلَيْهِ إِيَاسُ بْنُ خَيْثَمَةَ قَالَ‏:‏ أَلاَ أُنْشِدُكَ مِنْ شِعْرِي يَا ابْنَ الْفَارُوقِ‏؟‏ قَالَ‏:‏ بَلَى، وَلَكِنْ لاَ تُنْشِدْنِي إِلاَّ حَسَنًا‏.‏ فَأَنْشَدَهُ… ‏

    ” খালিদ ইবনে কায়সান ( রহ: ) বলেন, আমি হযরত ইবনে উমর (রা) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন ইয়াস ইবনে খায়ছামা (রহ) তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে ফারুক তনয় ! আমার কিছু কবিতা কি আপনাকে আবৃত্তি করে শুনাবো ? তিনি বলেন, হাঁ, তবে কেবল উত্তম কবিতাই শুনাবে। তখন তিনি তাঁকে তা আবৃত্তি করে শুনাতে থাকেন। (৩)

      উপরের আলোচনার দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম কবিতার হুকুম সাধারণ কথার মতোই। উত্তম কথার মতো উত্তম কবিতাও ইসলামে উত্তম বলে গণ্য হয়। আর ক্ষতিকর জিনিসে পূর্ণ কবিতা ইসলামে খারাপ বলে গণ্য হয়।

(৪)

     এবার আসুন আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি, কবিতার সাথে রাসুলের কোন সম্পৃক্ততা ছিলো কিনা ? তিনি কবিতা পছন্দ করতেন কিনা ? হাদিসের গ্রন্থগুলো অধ্যায়ন করলে দেখা যায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং কিছু কবি ও কবিতার প্রশংসা করেছেন যা দ্বারা ইসলামবিরোধীদের অভিযোগের অসারতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়।

ان من الشعر لحكمة

 ” নিশ্চয়ই কোনো কোনো কবিতায় প্রজ্ঞা রয়েছে।” (৪)

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَجُلاً، أَوْ أَعْرَابِيًّا، أَتَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَتَكَلَّمَ بِكَلاَمٍ بَيِّنٍ، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم‏:‏ إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ سِحْرًا، وَإِنَّ مِنَ الشِّعْرِ حِكْمَةً‏.

     ” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বা এক বেদুইন নবীজির নিকট উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় কথাবার্তা বললো। নবীজী তার কথায় মুগ্ধ হয়ে বললেন : কথায়ও যাদুকরী প্রভাব থাকে এবং কবিতাও প্রজ্ঞাপূর্ণ হতে পারে। ” (৫)

عَنْ عَمْرِو بْنِ الشَّرِيدِ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ رَدِفْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فَقَالَ ‏”‏ هَلْ مَعَكَ مِنْ شِعْرِ أُمَيَّةَ بْنِ أَبِي الصَّلْتِ شَيْئًا ‏”‏ ‏.‏ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ ‏”‏ هِيهِ ‏”‏ ‏.‏ فَأَنْشَدْتُهُ بَيْتًا فَقَالَ ‏”‏ هِيهِ ‏”‏ ‏.‏ ثُمَّ أَنْشَدْتُهُ بَيْتًا فَقَالَ ‏”‏ هِيهِ ‏”‏ ‏.‏ حَتَّى أَنْشَدْتُهُ مِائَةَ بَيْتٍ

     ” হযরত আমর ইবনে শারীদ (রহ) এর সনদে তাঁর পিতা শারীদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ এর (বাহনে) সফরসঙ্গী হলাম। তিনি বললেন, তোমার স্মৃতিতে (কবি) উমাইয়াহ ইবনে আবিস সালত এর কবিতার কোন কিছু আছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, পড়ো। আমি তখন তাঁকে একটি লাইন আবৃত্তি করে শুনালাম। তিনি বললেন, বলতে থাকো, তখন আমি তাঁকে আরও একটি শ্লোক পাঠ করে শুনালাম। তিনি আবার বললেন, বলতে থাকো। শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে ১০০ টি ছন্দ আবৃত্তি করে শুনালাম। (৬)

      এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, উমাইয়াহ ইবনে আবিস সালত ছিলেন জাহেলী যুগের একজন কবি কিন্তু তার কবিতায় উত্তম উপাদান থাকায় এবং অনিষ্টকর কোন কিছু না থাকায় স্বয়ং রাসুলুল্লাহ তাঁর কবিতা বেশ সময় নিয়ে শুনেছেন। যেখানে স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে কবিতা শোনার বিবরণ পাওয়া যায় সেখানে মানুষ এরপরও কিভাবে বলতে পারে যে, ইসলামে কবিতা হারাম অথবা ইসলাম মানুষের কাব্যপ্রতিভাকে হত্যা করে? 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ أَشْعَرُ كَلِمَةٍ تَكَلَّمَتْ بِهَا الْعَرَبُ كَلِمَةُ لَبِيدٍ أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مَا خَلاَ اللَّهَ بَاطِلٌ

    ” হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) এর সনদে নবীজী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আরবদের কবিতামালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাব্যময় বাণী হচ্ছে লাবীদের এই উক্তি।

”  أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مَا خَلاَ اللَّهَ بَاطِلٌ “

  ” জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু রয়েছে সবই বাতিল।” (৭)

     নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদিও নিজে কবি ছিলেন না কিন্তু কখনো কখনো তার মুখ থেকে এমন চমৎকার চমৎকার সব কথা বের হতো যেগুলো ছিলো সত্যিকারার্থেই অনেক প্রাণবন্ত এবং সাহিত্য রসে পরিপূর্ণ। সে কবিতাগুলো হতো অসাধারণ প্রেমমালায় ভরা অথবা আল্লাহর স্মরণে পূর্ণ মুগ্ধতা বহনকারী ।

عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ‏:‏ قُلْتُ لِعَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا‏:‏ أَكَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَتَمَثَّلُ بِشَيْءٍ مِنَ الشِّعْرِ‏؟‏ فَقَالَتْ‏:‏ كَانَ يَتَمَثَّلُ بِشَيْءٍ مِنْ شِعْرِ عَبْدِ اللهِ بْنِ رَوَاحَةَ‏:‏
ستبدی لک الایام ما کنت جاهلا
وَيَأْتِيكَ بِالأَخْبَارِ مَنْ لَمْ تُزَوِّدِ

    ” মিকদাম ইবনে শুরায়হ (রহ) থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়িশা (রা) কে বললাম, রাসুলুল্লাহ কি উপমা দেয়ার জন্য কবিতা পাঠ করতেন? তিনি বললেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার এ কবিতা আবৃত্তি করে উপমা দিতেন : যুগ অবশ্যই তোমাকে সে ব্যাপারে জানাবে যে ব্যাপারে তুমি অজ্ঞ ছিলে আর তুমি যাকে পথের পাথেয় দেওনি সে তোমার জন্য খবর নিয়ে আসবে (৮)

সহীহ বুখারীতে হযরত বারা ইবনে আযেব (রা:) হতে বর্ণিত আছে,

       আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খন্দকের মাটি বহনরত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছি। মাটি বহন করার কারণে তাঁর দেহ মুবারক ধূলোমলিন হয়ে ছিলো। এ অবস্থায় তাঁকে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার কবিতার নিম্নোক্ত চরণগুলো আবৃত্তি করতে শুনেছিলাম :

اللهم لولا أنت ما اهتدينا  **  ولا تصـدقنـا ولا صلينــا
فأنزلن سكينـة علينـا  **  وثبت الأقـدام إن لاقينــا
إن الألى رغبوا علينـا  ** وإن أرادوا فتـنـة أبينـــا

      ” হে আল্লাহ ! যদি তোমার অনুগ্রহ না হতো তাহলে আমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম না, আমরা দান খায়রাত করতাম না এবং সালাত আদায় করতাম না। অতএব আমাদের প্রতি শান্তি বর্ষণ করো এবং কাফিরদের সঙ্গে যদি আমাদের মোকাবেলা হয় তাহলে আমাদেরকে ধৈর্য্যদান করিও। তারা আমাদের বিরুদ্ধে লোকদের প্ররোচিত করেছে। যদি তারা ফেৎনা সৃষ্টি করতে চায় তাহলে আমরা কখনই মাথা নত করব না।

       হযরত বারা ইবনে আযিব বলেছেন, শেষের শব্দগুলো রাসুলুল্লাহ অধিক টান দিয়ে উচ্চারণ করছিলেন, অন্য একটি বর্ণনায় কবিতাটির শেষাংশ ছিল নিম্নরূপ :

إن الألى قـد بغـوا علينـا  **  وإن أرادوا فـتنـة أبينـا

       ” তারা আমাদের উপর অত্যাচার করেছে এবং তারা যদি আমাদেরকে ফেৎনায় নিক্ষেপ করতে চায়, আমরা কখনই মাথা নত করে তা মেনে নেবো না।’ (৯)

(৫)

      ইতিহাস আমাদেরকে বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের অনেকেই কবিতা চর্চা করতেন। ইমাম শা’বী (রাহ.) বলেন,

كان ابو بكر شاعرا وكان عمر شاعرا
وكان على شاعرا رضى الله عنهم

” আবু বকর (রা.) কবি ছিলেন। উমার (রা.)ও কবি ছিলেন। আর ‘আলী(রা.) ও কবি ছিলেন।” (১০)

      তাঁদের মধ্যে বিশেষত আলী (রা.) এর কাব্যচর্চায় সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালো কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ পাওয়া যায়। যাতে অনেকগুলো কবিতার মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। সাহাবী-তাবীঈদের যুগে কাব্যচর্চাকে শিক্ষার একটি উপাদান হিসাবে গণ্য করা হতো।

حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ سَلاَّمٍ، أَنَّ عَبْدَ الْمَلِكِ بْنَ مَرْوَانَ دَفَعَ وَلَدَهُ إِلَى الشَّعْبِيِّ يُؤَدِّبُهُمْ، فَقَالَ‏:‏ عَلِّمْهُمُ الشِّعْرَ يَمْجُدُوا وَيُنْجِدُوا

    ”  উমর ইবনে সাল্লাম ( রহ: ) থেকে বর্ণিত আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তার সন্তানদের আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়ার জন্য ইমাম শাবী (রহ) এর নিকট সোপর্দ করেন। তিনি বলেন, এদের কবিতা শিক্ষা দিন, তাতে তারা উচ্চাভিলাসী ও নির্ভীক হবে। ” (১১)

      ইমাম শাফিঈ (রহ) কাব্যচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর একটি সুবিখ্যাত কবিতার সংকলন রয়েছে। ইসলামের মুবারক যুগে ইসলামী কবিতা ব্যতিতও নানা জায়েজ দুনিয়াবী বিষয়ে কাব্যচর্চার বিপুল পরিমাণে উদাহরণ পাওয়া যায়। আগ্রহীরা প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে ইমাম কুরতুবী এই গ্রন্থগুলো অধ্যায়ন করলে দেখতে পারবেন আমাদের আকাবির আসলাফের মধ্যে কাব্যচর্চার সুদীর্ঘ সুন্দর ইতিহাস।

       আরো আশ্চর্যের একটি বিষয় হলো কুরআনুল কারিমের একটি সুরার নামকরণই করা হয়েছে কবিদের নামে। পবিত্র কুরআনুল কারীমের ২৬ নং সুরার নাম সুরা শু’আরা (কবিগণ)। এ সুরাতে কবিদের নিন্দা করে একটি আয়াত আছে। এ আয়াতটি দেখিয়েই অনেকেই বলতে চান যে ইসলামে সবধরণের কবি ও কবিতা নিন্দিত। আয়াতটি হচ্ছে –

 وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ

    ” আর বিভ্রান্তরাই কবিদের অনুসরণ করে। ” (১২)

       আয়াতটির মর্মার্থ বুঝার জন্য আসুন আমরা এই আয়াতের তাফসির দেখে আসি। তাফসিরে ইবনে কাসিরে আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট উল্লেখ আছে। ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একজন আনসারী ও একজন অন্য সম্প্রদায়ের লোক কবিতার মাধমে একে অন্যের নিন্দায় লিপ্ত ছিলো। তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কিছু মূর্খ লোক এই কাজে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছিলো। এরই ভিত্তিতে উক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। (১৩)

      আয়াতের শানে নুযুল এর দ্বারা আমাদের সামনে এটা স্পষ্ট হলো যে কিছু কবির অনিষ্টকর কাজ ও তাদের অনুসরণ করা কিছু লোকের ব্যাপারে আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে । এতে মোটেও সকল প্রকার কবি ও কবিতার কথা বলা হয়নি। যে আয়াতে একে অন্যের নিন্দাকারী ও এ কাজ সমর্থন করা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কথা বলা হলো, সেই আয়াত দেখিয়ে ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় যে ইসলামে নাকি সব কবিতা হারাম! মূলত এটা তাদের সীমাহীন অজ্ঞতারই পরিচায়ক।

     আলোচ্য আয়াতের প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত আছে, ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। “আর বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখো না যে, তারা প্রতিটি ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, আল্লাহকে পর্যাপ্ত স্মরণ করে এবং নির্যাতিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নির্যাতনকারীরা অচিরেই জানতে পারবে তাদের গন্তব্য কিরূপ ” । (১৪)

(৬)

       আরব জাতির ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে দেখা যায় যে রাসুলুল্লাহ এর যুগে অন্ধ গোত্রবিদ্বেষ, অশ্লীল প্রেম এবং নানা রকমের অনিষ্টকর জিনিস নিয়ে কবিতা আরবদের মাঝে খুবই প্রচলিত ছিলো। বিভিন্ন হাদিসে অনিষ্টকর কবি ও কবিতার ব্যাপারে নিন্দাসূচক কথা এসেছে। ইসলামে কেবল সে সকল কবিতা নিষিদ্ধ যেগুলোতে হারাম ও অনিষ্টকর উপাদান আছে। সামনের হাদিস দুটো দেখলেই আমাদের সামনে বিষয়টিও স্পষ্ট হবে :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ لأَنْ يَمْتَلِئَ جَوْفُ الرَّجُلِ قَيْحًا يَرِيهِ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَمْتَلِئَ شِعْرًا ‏”‏

      ” হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন : কোনো লোকের পেট পুঁজ দিয়ে ভর্তি হয়ে যাওয়া যা তার পেট পঁচিয়ে বিনষ্ট করে দেয়, তা কবিতায় পেট ভর্তি হওয়ার চাইতে উত্তম।  (১৫)

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ‏:‏ إِنَّ أَعْظَمَ النَّاسِ جُرْمًا إِنْسَانٌ شَاعِرٌ يَهْجُو الْقَبِيلَةَ مِنْ أَسْرِهَا، وَرَجُلٌ انْتَفَى مِنْ أَبِيهِ

     ” আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজী বলেনঃ মানুষের মধ্যে মারাত্মক অপরাধী হলো সেই কবি যে সমগ্র গোত্রের নিন্দা করে এবং যে ব্যক্তি নিজ পিতাকে অস্বীকার করে। (১৬)

(৭)

     এবার আসুন আমরা একটু দেখি সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন ও আমাদের পরবর্তী আকাবির আসলাফ কবিতার ব্যাপারে কেমন ধারণা পোষণ করতেন ? তাদের থেকে কবিতার ব্যাপারে নিন্দামূলক কোন কিছু প্রমাণিত আছে কিনা ? কবিতা আবৃত্তির ব্যাপারে কেমন ছিলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ?

      হযরত আবু বকর (রা) বলেছেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের কবিতা শিক্ষা দাও। কারণ, তা তাদেরকে উন্নত আখলাক শিক্ষা দেবে।

      হযরত উমর (রা) বলেছেন, ” তোমরা কবিতা সংরক্ষণ করো কারন কবিতা মানুষকে সচ্চরিত্রবান হবার শিক্ষা দেয়। উন্নত আমলের প্রতি পথপ্রদর্শন করে। উত্তম কর্মের জন্য সবাইকে উৎসাহিত করে। “

       হযরত মুয়াবিয়া (রা) বলেছেন, ” প্রত্যেক ব্যক্তির স্বীয় সন্তানকে সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। আর কবিতা হলো সবচেয়ে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য।

       ইমাম শাফিয়ী (রহ) বলেছেন, ” দ্বীনি কোন বিষয়ে কারও জন্য ফতোয়া প্রদান করা ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে আল্লাহর কিতাব, এর নাসিখ ও মানসুখ (রহিতকারী ও রহিত আয়াত সমূহ),  মুহকাম-মুতাশাবিহ (সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট) আয়াত সম্পর্কে অবগত না হবে। এর সাথে তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস সম্পর্কেও জ্ঞানবান হতে হবে। আরবী ভাষা ও কবিতা সম্পর্কেও বিচক্ষণ হতে হবে।” (১৭)

     ইমাম ইবনে কুদামাহ হাম্বলী (রহ) বলেছেন, ” কবিতা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মতানৈক্য নেই। সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতের উলামারাও কবিতা রচনা করেছেন। আরবী ভাষার মর্মার্থ জানা, কুরআনের তাফসিরের জন্য কবিতার মাধ্যমে দলিল পেশ করা, আল্লাহ ও তার রাসুলের কথার অর্থ বোঝা ইত্যাদি নানান কারনেই কাব্যচর্চার প্রয়োজন রয়েছে।” (১৮)

    ইবনে বাত্তাল (রহ) বলেন, যে কবিতায় আল্লাহর একত্ববাদ, তার স্মরণ ও ইসলামের প্রতি ভালোবাসা বর্ণিত হয় তা কাম্য ও গ্রহণীয়। (১৯)

      আমরা যদি উপরের আলোচনা ভালোভাবে বুঝে থাকি তাহলে আমাদের সামনে এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়ের নিন্দাবাদ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা একটি অনিষ্টকর কাজ। হাদিসে এই জাতীয় কবিতা লেখাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে।

     আমাদের মনে রাখা উচিত, এমন নারী বা পুরুষের ব্যাপারে প্রেমের কবিতা লেখা জায়েজ নেই যে নারী বা পুরুষ ঐ কবির জন্য বৈধ নয়। কিন্তু নিজ স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে ভালোবাসার কবিতা লেখা হালাল তো বটেই বরং সওয়াবের কাজ। হারাম জিনিস বাদে অন্য সকল জিনিস নিয়ে কবিতা লেখা যায়, সে ধরণের কবিতা লেখাকে পেশা হিসেবেও নেয়া যায়।

     ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) এর মতে ” যদি অতিমাত্রায় আবৃত্তি না করা হয়, মসজিদের ভেতর শেয়েরের মজলিস না করা হয়, যদি অন্যায়ভাবে কারো মানহানী না করা হয়, কারো মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা না করা হয়, মিথ্যাচার না থাকে কবিতায় আর অশ্লীল প্রেমকাহিনীও না থাকে তাহলে কবিতা লেখা জায়েজ।
  
     ইমাম ইবনে কুদামা মাকদিসি (রহ) বলেছেন,
” কবিতা লেখা জায়েজ। এ নিয়ে ভিন্ন কোনো অভিমত নেই। এটাই সাহাবী ও আলেমদের অভিমত। ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ) নিজেও কবিতা জায়েজ হবার ব্যাপারে আলেমদের ইজমা উল্লেখ করেছেন। ” (২০)
 
      কাজেই কবিদের আল্লাহ তায়ালা ও রাসুলের শানে স্তুতিমূলক কবিতাগুলো (যাতে শিরক বা বিদআত নেই) ইসলামে উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে। একইভাবে জায়েজের সীমার মধ্যে থেকে শিক্ষামূলক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমূলক এবং জীবনের নানা দিক নিয়ে কবিতা লেখা, পাঠ করা যেতেই পারে। ইসলাম কখনোই তা নিষেধ করে না।

      উপরের আলোচনার আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে ইসলামে মোটেও সব কবিতা নিষিদ্ধ নয়।
” ইসলামে ঢালাওভাবে সকল কবিতা বা সাহিত্যকর্ম নিষিদ্ধ ” এটা একটা চরম অসত্য কথা। যে সকল কবিতা বা সাহিত্যকর্মের দ্বারা অনিষ্ট হতে পারে, ইসলাম কেবল সেগুলোকেই নিষিদ্ধ করেছে। মানুষের প্রতিভাকে বিনষ্ট করা মোটেও ইসলামের উদ্যেশ্য নয় বরং মানবজাতির কল্যাণের জন্যই ইসলাম। এটা তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা নির্মোহভাবে ইসলাম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে।

(৮)

     এবার আসুন আমরা আমাদের কবিতা লেখা ও কাব্যচর্চার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু কথা বলি। আমরা কেন কবিতা লিখবো? কেনই বা আমরা চাই কাব্যের ময়দানে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে? কেনই বা আমরা আমাদের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করছি কবিতা লেখার পিছনে?

     আসলে আমাদের কাব্যের জগতে আসার পিছনে সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করা, রাসূলের ভালোবাসাকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া এবং দ্বীনের সৌন্দর্যগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা।

      আমাদের কবিতায় যেন প্রাণচঞ্চল হয় একটি জাতি। আমাদের কাব্যে ভেঙে পড়া সমাজব্যবস্থা যেন ফিরে পায় নিজেদের অবকাঠামো। আমাদের নিজেদের হৃদয়ের সুন্দরতম চিন্তাধারা আমরা যেন ছড়িয়ে দিতে পারি পুরো বিশ্বে। বাতিলের বিরুদ্ধে, দুষ্টের দমনে এবং সমাজে জাগরণ সৃষ্টি করতে আমাদের কবিতাগুলো যেন রাখতে পারে প্রতিভার স্বাক্ষর !!

     আমরা চাই আমাদের কবিতাগুলো হোক মহাকবি আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির কবিতার মত হৃদয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টিকারী! 
 
    আমাদের কাব্যগুলো যেন মহাকবি শেখ সাদীর কবিতার মত হৃদয়ে উদ্বেলিত করে নবীপ্রেম ও রাসূলের ভালবাসা! 

    আমাদের কবিতাগুলো যেন হয় হাসসান বিন সাবিতের কবিতাগুলোর মত পরকালের চিন্তা সৃষ্টিকারী ও জনকল্যাণের দিকনির্দেশনা প্রদানকারী ।

    আমাদের কবিতাগুলো যেন আবার আমাদের মাঝে  ফিরিয়ে আনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের আঙ্গিকে ইসলামের বিপ্লবী চিন্তাধারা !

    মহাকবি আল্লামা ইকবালের শাশ্বত পয়গাম যেন আবারো ফুটে ওঠে আমাদের ক্ষুদ্র কবিতাগুলোতে !

    আমাদের কবিতাগুলোতে যেন ফুটে ওঠে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো গ্রামীণ সুন্দর পরিবেশ ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অপরূপ সৃষ্টির কথা !

      আমরা চাই, আমরা একদিন মহীরুহ হয়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিবো সুন্দর কাব্য ও ঈমানী সুসাহিত্যের বাতাস।

     একটি চারা যেমন একদিনেই বড় হয়ে যায় না। ফল, ফুল ও সৌরভ দেওয়ার জন্য যেমন তাকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ একটি সময়। মোকাবেলা করতে হয় অনেক ঝড়-ঝাপটার। টিকে থাকতে হয় বিক্ষুব্ধ বাতাসের মুখেও। তেমনি আমরাও চাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা সহ্য করে যাবো বাতিলের শত হুংকার ও বজ্রধ্বনী। আমাদের প্রতিটি রক্তফোটা যেন হয় সেই মহান রব্বুল আলামীনের জন্যই সমর্পিত !

      আমি চাই , আমরা প্রত্যেকে হবো কাব্যের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত সৈনিক, রাসূলপ্রেমে নিজেদেরকে উৎসর্গকারী মহান ব্যক্তিত্ব। আমাদের প্রত্যেকের কবিতা হোক বাতিলের বিরুদ্ধে শানিত তরবারী। আমাদের প্রত্যেকের লেখা হোক পরকালের চিন্তাউন্মেষকারী মহাকাব্য!

~  এই প্রত্যাশায় !!
~  আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন !!
 হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিয়মাল ওয়াকিল !!

তথ্যসূত্রঃ
———-

(১) আদদারাকুতনী, আদাবুল মুফরাদ। হাদিস : ৮৭৩
(২) আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস : ৮৭৪
(৩) আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস : ৮৬৪
(৪) সহীহ বুখারী , হাদিস : ৬১৪৫
(৫) আবু দাউদ, আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস : ৮৮০
(৬) সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৫৭৭৮
(৭) সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৫৭৮১
(৮) তিরমিযী, আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস : ৮৭৫
(৯) সহীহ বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৯ পৃষ্ঠা
(১০) মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, আদব অধ্যায়,  হাদিস : ৩৬৬,আল-মুসান্নাফ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৭৩
(১১) তারীখুল কাবীর, ইলালে আবি হাতিম, ইবনে হিব্বান, আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস : ৮৮১
(১২) সুরা শু’আরা : আয়াত ২২৪
(১৩) তাফসিরে ইবন কাসির,
 সুরা শু’আরার ২২৪ নং আয়াতের তাফসির।
(১৪) আবু দাউদ,আল আদাবুল মুফরাদ। হাদিস : ৮৭৯
(১৫) সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৫৬৯৬
(১৬) সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস : ৩৭৬১,
(১৭) আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ,
লিল খতীব আল বাগদাদী ২/১৫৭
(১৮) আল-মুগনী লি ইবনে কুদামাহ হাম্বলী। ১০/১৫৮
(১৯) মারেফুল কুরআন : পৃষ্ঠা ৯৮৬
(২০) আল মুগনী ১০/১৭৬
 মাওসু’আহ আল ফিকহিয়্যাহ ২৬/১১৩-১১৭

লেখকঃ ইমতিয়াজ বুরহান।

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment