যিনা‌ এর ভয়াবহতা এবং এ থেকে বাঁচার উপায়

Spread the love

 ইসলামী শরিয়াহর পরিভাষায় বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর মধ্যে অবৈধ physical relation কে‌ যিনা বলে‌। এটি মারাত্মক একটি গুনাহ‌ হলেও বর্তমানে এই জঘন্য গুনাহের‌ সয়লাভ‌। বক্ষ্যমাণ আর্টিকেলটিতে‌ আমরা জিনা‌, এর ভয়াবহতা এবং এ থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানব ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে জিনা‌ সহ সকল প্রকার অশ্লীলতাকে‌ নিষেধ‌ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَا تَقْرَبُوْا الزِّنَا، إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَآءَ سَبِيْلًا

“তোমরা জিনার ধারেকাছেও যেয়ো‌ না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট পন্থা।” [১]

‌قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ

“বলুন, আমার রব হারাম করেছেন সকল প্রকার প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা।” [২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”তোমরা জিনা থেকে দূরে থাকো যা আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।” [৩]

জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলো,”হে আল্লাহর রাসূল! কোন পাপটি আল্লাহ তাআলার নিকট মহাপাপ বলে বিবেচিত?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,”আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করা; অথচ, তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” সে বললো,”অত‌ঃপর কি?” তিনি বললেন,”নিজ সন্তানকে হত্যা করা ভবিষ্যতে তোমার সঙ্গে খাবে বলে।” সে বললো,”অতঃপর কি?” তিনি বললেন,”নিজ প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে জিনা‌ করা।” [৪]

এবার আমরা জিনার‌‌ ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোকপাত করব।

১) জিনাকারের‌ জন্য রয়েছে দুনিয়াতে কঠিন শাস্তি। অবিবাহিত‌ জিনাকারীর শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

الزَّانِيَةُ وَالزَّانِيْ فَاجْلِدُوْا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِئَةَ جَلْدَةٍ، وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِيْ دِيْنِ اللهِ، إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْـمُؤْمِنِيْنَ

“জিনাকারিণী ও জিনাকারী; তাদের প্রত্যেককে তোমরা একশ করে বেত্রাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান কার্যকরে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত করতে না পারে যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাকো এবং মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” [৫]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”অবিবাহিত জিনাকার যুবক-যুবতীর শাস্তি হচ্ছে, একশটি বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ ও মহিলার শাস্তি হচ্ছে, একশটি বেত্রাঘাত ও রজম তথা পাথর মেরে হত্যা।” [৬]

এছাড়া, জিনার শাস্তি দেওয়া হয় সবার সম্মুখে এবং এই শাস্তির বিধান কার্যকরে কারো সুপারিশ‌ও গ্রহণযোগ্য নয়।

২) যারা‌ জিনা‌ করে তাদের ঈমানে‌ মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”কোনো জিনাকারী‌ জিনা করার সময় মুমিন থাকে না।” [৭] অন্য‌ হাদিসে তিনি বলেন,”কোনো ব্যক্তি জিনা‌ অথবা মদ পান করলে আল্লাহ তাআলা তার ঈমান ছিনিয়ে নিবেন যেমনিভাবে কোন মানুষ তার জামা নিজ মাথার উপর থেকে খুলে নেয়।” [৮]

৩) জিনাকারের‌ কবরে আযাব‌ হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ তাঁর একটি স্বপ্নের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,”আমরা সামনে অগ্রসর হলাম‌। একটি আগুনের গর্ত দেখতে পেলাম। আগুনের লেলিহান শিখা যখন উপরের দিকে উঠতো, তখন তার ভিতরে যারা রয়েছে তারাও উপরে উঠে আসতো এবং উক্ত গর্ত হতে বাইরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি?” ফিরিশতারা‌ পরবর্তীতে উত্তর দিয়েছিলেন,”তারা জিনাকার‌ পুরুষ ও নারী।” [৯]

৪) জিনাকার আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَالَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللهِ إِلَـهًا آخَرَ، وَلَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْـحَقِّ، وَلَا يَزْنُوْنَ، وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا، يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيْهِ مُهَانًا”

“আর যারা আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কোনো উপাস্যকে ডাকে না। আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং জিনা করে না। যারা এগুলো করবে তারা অবশ্যই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। কিয়ামতের দিন তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে এবং তারা ওখানে স্থায়ীভাবে লাঞ্ছিতাবস্থায় থাকবে।” [১০]

৫) জিনা বৃদ্ধি পাওয়া কিয়ামতের আলামত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে, ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, মূর্খতা ছেয়ে যাবে, মদ পান করা হবে এবং প্রকাশ্যে জিনা সংঘটিত হবে।” [১১]

এবার আমরা জিনা‌ থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানব ইনশাআল্লাহ।

১) দৃষ্টিকে হেফাজত করা। দৃষ্টি শয়তানের একটি বিষাক্ত তীর। তাই দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُلْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ، وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ، ذَلِكَ أَزْكَى لَـهُمْ، إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ، وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ، وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ.

“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তারা নিজ দৃষ্টিকে সংযত করে এবং নিজ লজ্জাস্থানকে হিফাযত করে। এটাই তাদের জন্য পবিত্র থাকার সর্বোত্তম মাধ্যম। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের কর্ম সম্পর্কে অধিক অবগত। তেমনিভাবে মুমিন মহিলাদেরকেও বলুন, তারা যেন নিজ দৃষ্টিকে সংযত করে এবং নিজ লজ্জাস্থানকে হিফাযত করে।” [১২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক আদম সন্তানের জন্য জিনার কিছু অংশ বরাদ্দ করে রেখেছেন। চোখের জিনা হচ্ছে অবৈধভাবে কারোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া।” [১৩]

সুতরাং, চোখের‌ দৃষ্টির মাধ্যমেও জিনা‌ হয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ এর এই উপদেশটি মনে রাখতে হবে,”হে‌ আলী! বার বার দৃষ্টি দিও না। কারণ, (হঠাৎ) প্রথমবার দৃষ্টিতে তোমার দোষ নেই। তবে দ্বিতীয় দৃষ্টি অবশ্যই দোষের।” [১৪]

২) জিনার‌ সকল মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া। যেমন‌: গান বাজনা, নাচ‌, অশ্লীল মুভি‌, নাটক ইত্যাদি না দেখা। পাশাপাশি, ছেলে মেয়েকে‌ কেন্দ্র করে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, জাস্টফ্রেন্ড, বিবাহপূর্বক রিলেশন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা। কারণ, এগুলো গুনাহ ও জিনার‌ অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَلَا تَقْرَبُوْا الزِّنَا، إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَآءَ سَبِيْلًا

“তোমরা জিনার ধারেকাছেও যেয়ো‌ না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট পন্থা।” [১৫]

৩) জিনার‌‌ ভয়াবহতা সম্পর্কে চিন্তা করা এবং আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ اتَّقُوا اللّه. اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ.

“আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা যা‌ করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।” [১৬]

৪) জিনা‌ থেকে বিরত থাকার সুফল সম্পর্কে চিন্তা করা। আল্লাহ তায়ালা সফলকাম জান্নাতী মুমিনদের‌ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন,

وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ

“যারা‌ তাদের লজ্জাস্থানকে হিফাজত করে।” [১৭]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”হে‌ কুরাইশ যুবকরা! তোমরা নিজ লজ্জাস্থানের হিফাজত করো। কখনো জিনা করো না। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি নিজ লজ্জাস্থানের হিফাজত করতে পেরেছে তার জন্যই তো জান্নাত।” [১৮]

পাশাপাশি, জান্নাতের হুরদের‌ কথা চিন্তা করলে দুনিয়ার‌ মেয়েদের সাথে জিনা করার আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই কমে যাবে‌ ইনশাআল্লাহ।

৫) সামর্থ্যবান হলে বিবাহ করা অথবা রোজা রাখা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম‌ বলেন,”হে‌ যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন অবশ্যই বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ দৃষ্টি অবনত করে ও লজ্জাস্থানের অধিক হিফাজত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোজা যৌন‌তাড়না দমন করে।” [১৯]

পরিশেষে, আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া‌‌ করছি, তিনি‌ যেন‌ আমাদের সবাইকে জিনার‌ মতো মারাত্মক গুনাহ থেকে হেফাজত করেন এবং সবাইকে পবিত্র থাকার তৌফিক দান করেন আমিন।

ফুটনোট:

[১] সূরা বানি‌ ইসরাঈল:৩২
[২] সূরা আরাফ:৩৩
[৩] মুস্তাদরাকে হাকিম‌:৪/২৭২
[৪] সহিহ বুখারী:৪৪৭৭
[৫] সূরা নূর‌:০২
[৬] সহিহ মুসলিম:১৬৯০
[৭] সহিহ বুখারী:৬৩১৫
[৮] মুস্তাদরাকে হাকিম‌:১/২২
[৯] সহিহ বুখারী:৭০৪৭
[১০] সূরা ফুরকান‌:৬৮-৬৯
[১১] সূরা নূর‌:৩০-৩১
[১২] সহিহ বুখারী:৬২৫৭
[১৩] সহিহ বুখারী:৮০
[১৪] সুনানে‌ আবু দাউদ:২১৪৯
[১৫] সূরা বানি‌ ইসরাঈল:৩২
[১৬] সূরা মায়িদাহ:০৮
[১৭] সূরা মুমিনুন:০৫
[১৮] সহিহ তারগিভ‌ ওয়াত‌ তারহিভ‌:২৪১০
[১৯] সহিহ বুখারী:৫০৬৬

লিখেছেনঃ ইমতিয়াজ বুরহান ভাই

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment