আমাদের প্রজন্মের বাচ্চারা কার্টুনের প্রতি একটু বেশিই আসক্ত। নানা ধরনের কার্টুন আর হরেক রকমের গেমস খেলে কেটে যায় তাদের সময়। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো, যে সময়টা তাদের মেধাবিকাশ ও উন্নত চিন্তাচেতনা গঠনের সময় তখন আমরাই তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি বেহুদা ও অনর্থক সব জিনিস। কচি বয়সেই তাদের অন্তরে বপন করে দিচ্ছি বাজে কাজের প্রতি ভালোবাসা। শৈশবের রঙিন মুহূর্তগুলোতে তাদের অন্তরে আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সম্মান প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে আমরা তাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিচ্ছি এমন এক জগত যেখানে শুধুই আছে সময় অপচয় ও মেধার বিনাশ।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা
ইরশাদ করেছেন :
فطرة الله التی فطر الناس علیها
প্রকৃত দ্বীনি চেতনা সেটাই যার উপর আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। (1)
ইমাম কুরতুবী ( রহ:) এই আয়াতের তাফসীরে অত্যন্ত চমৎকার কথা লিখেছেন :
معنى ذلك اتبعوا دين الله الذي خلق الناس له، وسميت الفطرة دينا لأن الناس يخلقون له
অর্থাৎ এই আয়াতের মর্ম হলো ঐ দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণ করো যার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষদের সৃষ্টি করেছেন। আর ফিতরাতকে দ্বীন বলা হয়েছে কারন আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে দ্বীনের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। (2)
হাদীসে এসেছে আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন :
کل مولود یولد علی الفطرة فابواه یهودانه و ینصرانه و یمجسانه
প্রত্যেকটি শিশুই দ্বীনি ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে তার বাবা-মা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা ও অগ্নিপূজক বানায়। (3)
প্রতিটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পর একটু বুঝতে শিখলেই সে নিজের বাবা-মাকে অনুসরণ করতে শেখে। মা যদি নামাজ পড়ে তাহলে দেখা যায় ছোট বাচ্চাও তার পাশে বসে সেজদা দিচ্ছে। বাবাকে যদি সে কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করতে দেখে তাহলে সেও কোরআন শরীফকে চুমু খায়, সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। বাবাকে যদি সে মসজিদে যেতে দেখে তাহলে সেও আবদার করে মসজিদে যাওয়ার জন্য। ঠিক এভাবেই যখন বেড়ে উঠে একটা শিশুর স্বভাবজাত দ্বীনি চেতনা তখন আমাদের মায়েরাই তাদের হাতে ধরিয়ে দেয় এই ধ্বংসাত্মক কার্টুন ও সময় অপচয়কারী সব গেমস।
আমাদের মায়েদের যেখানে উচিত ছিল, খাওয়ার সময় তিনি সন্তানকে পাশে বসিয়ে শোনাবেন সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, ইসলামের গৌরবময় সোনালি উপাখ্যান, তখন তারা নিজেরাই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন দামী মোবাইল ফোন ও ওয়াইফাই কানেকশন । ফলাফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামকে নিজেদের জীবনের জন্য আইডল বানানোর পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে বানাতে চাচ্ছে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান ও অন্যান্য কাল্পনিক চরিত্রের নায়কদের মত।
আমরা যখন তাদেরকে এসব কার্টুন দেখার জন্য অনুপ্রাণিত করি তখন আমাদের মাথায় থাকেনা যে, যাদু করা হারাম, ছবি তোলার ব্যপারে রয়েছে ইসলামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা । এসব কার্টুনে যখন সে জাদু করা ও অন্যান্য শিরকী কাজকর্ম দেখে তখন নিজের অজান্তেই সে প্রভাবিত হয়। তার অন্তরেও স্বপ্ন জাগে এসব কল্পিত মানবদের মত হওয়ার। কার্টুনের জগতকে সে বাস্তবের জগতে সাথে মিলিয়ে ফেলতে চায়।
আমরা ছোটবেলায় অনেকেই গোপাল ভাঁড় কার্টুনটি দেখেছি। সেটা দেখে আমরা অনেক আনন্দ পেতাম কিন্তু এর মাধ্যমে আমাদের শিশু কিশোর ও বাচ্চাদের মন-মগজে যেভাবে শিরকি ও কুফুরী রসম-রেওয়াজ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটা আমাদের কারো মাথায়ই আসেনা। গোপাল ভাঁড়ের কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, নবাব সিরাজদৌল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা কট্টর হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব সম্পর্কে ইতিহাসে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেলেও কোথাও উল্লেখ নেই যে, তাঁর সভায় গোপাল নামে একজন ভাঁড় ছিলেন।
সব ধরণের পূজা – পার্বণ কিভাবে পালন করা হয় তার সবটাই দেখানো হয় এই গোপাল ভাঁড় কার্টুনে । আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো, এই কার্টুনে পরোক্ষভাবে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেনস্তা করা এবং হিন্দুদের বিজাতীয় সব সভ্যতা – সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়ার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আজ আমাদের সন্তানরা ভালোভাবে কথা বলতে পারার আগেই মোবাইলে এক্সপার্ট হয়ে যায়। তাদের ফোন চালানো এবং গেমস খেলা দেখে আমরা নিজেরাই হতবাক হয়ে যাই । ফলাফলটা এমন দাঁড়িয়েছে, আমাদের বাচ্চারা তিন দিন না খেয়ে থাকতে পারবে কিন্তু একটা দিনও তারা মোবাইল এবং ইন্টারনেট ছাড়া থাকতে পারবে না। তাদের হাতে মোবাইল দিয়ে ছেড়ে দিলে সারাদিন গেমস খেলে আর কার্টুন দেখে অতিবাহিত করতে পারবে কিন্তু পড়তে বসলে অল্প সময়ে তাদের মাথা ধরে যাবে, ঘুমে ক্লান্তি চলে আসবে, লেখাপড়ায় মনোযোগ থাকবে না। এর জন্য মূলত আমরাই দায়ী।
আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, একদম ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের কার্টুন দেখার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চারা ৬ মাস বয়স থেকে কার্টুন দেখা শুরু করে এবং ২-৩ বছরের মধ্যেই কার্টুনের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেক মায়েরাই বাচ্চাদের মন ভোলানোর জন্য এই কার্টুনের সাহায্য নিয়ে থাকেন। এই অভ্যাস বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। চলুন ! আজ আমরা জেনে নেই কিভাবে কার্টুন বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে ঘাটতি তৈরি করে।
১ / কার্টুন দেখার জন্য দীর্ঘক্ষণ টিভি বা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে প্রচন্ড চাপ পড়ে। একটানা টিভি দেখার অভ্যাস করলে আস্তে আস্তে বাচ্চাদের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
২/ অতিরিক্ত কার্টুন দেখার কারনে বাচ্চাদের শারীরিক ব্যায়ামে ঘাটতি ঘটে। বাড়ন্ত হওয়ার জন্য শিশুদের শারীরিক ব্যায়াম ও চলাফেরা খুবই প্রয়োজন। কার্টুনের নেশা হয়ে গেলে বাচ্চারা আর বাড়ির বাইরে বেরোতে চায় না। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, বাইরে বেরোলে বাচ্চারা প্রকৃতির সৌন্দর্যতা অনুভব করতে পারে। এই অনুভূতি তাদেরকে প্রকৃতির আরো কাছে নিয়ে যায়। শারীরিক বিকাশের ঘাটতি মানসিক বিকাশেও অবনতি ডেকে আনে। বাচ্চারা ঘরে বসে টিভি বা মোবাইলে কার্টুন দেখলে শারীরিক পরিশ্রম না হওয়ার ফলে তাদের বেড়ে উঠতেও বাঁধার সৃৃষ্টি হয়।
৩. বাচ্চারা কার্টুন না দেখলে খেতে চায় না।
অনেক মায়েরা বাচ্চাদের কার্টুন দেখিয়ে মন ভুলিয়ে খাওয়ান। বাচ্চাদের এই অভ্যাস করানো একদমই উচিত না। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে কিছুদিন পর দেখা যায়, তারা কার্টুন না দেখতে পেলে খেতেই রাজি হচ্ছে না। এর ফলে বাচ্চাদের খাওয়ার অভ্যাসও চলে যায়।
৪. বাচ্চাদের সামাজিক জীবনেও কার্টুনের কারনে বিস্তর প্রভাব পড়ে। সারাদিন বাচ্চারা কার্টুন দেখলে একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে । ফলাফলে তারা নতুন বন্ধু পাতানো বা অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে চায় না। অন্য কারো সাথে দেখা করা বা বন্ধুত্ব না হলে বাচ্চারা অন্যদের সাথে খেলার আনন্দই বুঝতে পারবে না। আমরা জানি, বাচ্চারা অন্যদের দেখে শেখে। অন্য বাচ্চাদের সাথে যদি তার দেখাই না হয় তাহলে শিশুদের মানসিক বিকাশেও ঘাটতি ঘটে।
অতিরিক্ত কার্টুন দেখলে বাচ্চারা তাদের প্রিয় কার্টুনের চরিত্রদের মতোই কথা বলতে শেখে।কোনো কথার উত্তর দিতে হলে তারা কার্টুনের চরিত্রদের মতো করেই উত্তর দেয়। অনেক সময় তারা বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করেও উত্তর দেয় যা তারা কার্টুন দেখে রপ্ত করে থাকে। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার থেকে এই অভ্যাসটি বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের অবনতি ঘটায়।
বাচ্চারা কার্টুন দেখে মারামারি করা শেখে। তারা অভিনয় এবং আসল মারপিটের পার্থক্য বোঝে না। অনেক সময় কার্টুনে দেখা যায়, একটি চরিত্র আরেকটি চরিত্রকে মারার পরও পরের সিনেই সব চরিত্র আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফলে বাচ্চারাও ভাবে যে, মারামারি করলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কার্টুনের এই প্রভাবটি মারাত্বক ক্ষতিকর । তাই অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাদের কার্টুন দেখার অভ্যাস আস্তে আস্তে কমিয়ে দেওয়া। কার্টুন দেখার অভ্যাস আমাদের অজান্তেই বাচ্চাদের অনেক ক্ষতি করে দেয়। তাই আমাদের উচিত বাচ্চাদেরকে বাড়ির বাইরে নিয়েও গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলানো এবং ছোটদের ভালো গল্পের বই পড়ানোর অভ্যাস করানো যাতে তাদের মানসিক বিকাশে উন্নতি হয়।
আমাদের মনে রাখা উচিত, শিশুরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত। তাদেরকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখা উচিত। তাদের দৈহিক ও মানসিক উন্নতির জন্য আমাদের সকল সর্বদা চেষ্টা করা উচিত। আমরা যদি তাদের মানসিক ও দৈহিক উন্নতির প্রচেষ্টা না করি তাহলে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ংকর পরিস্থিতি। হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন নিজেদেরকেই দেখতে হবে প্রিয় সন্তানদের ধ্বংস। তখন নিজেদের আফসোস করা ছাড়া আর কোন কাজই থাকবে না আমাদের। তাই আসুন! এখনই সচেতন হই !!
লেখাঃ ইমতিয়াজ বুরহান।
তথ্যসূত্র :
———-
(1) সূরা রুম : আয়াত ৩০
(2) তাফসীরে কুরতুবী / খন্ড ১৪ / পৃষ্ঠা ২৪
(3) সহীহ মুসলিম হাদীস (২৬৫৮)