লোক দেখানো আমল – শিক্ষণীয় গল্প

Spread the love

 [১]

মানুষের জীবনে ঈমান আনয়নের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নেক আমল। এই নেক আমলই একজন মানুষের সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী। এটি এমনই এক উত্তম সঙ্গী যা কোনোদিনই একা রেখে ছেড়ে যাবার নয়। কবরের ঘুটঘুটে অন্ধকার জগতে এবং কিয়ামতের দিন একমাত্র এই সঙ্গীই সাথে থাকবে। রাহমানুর রাহিমের হুকুমে জাহান্নামের মতো কঠিন আযাবের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে এই নেক আমল। বলা চলে, নেক আমল সমস্ত আযাবের ঢালস্বরূপ। ফলে নেক আমলের গুরুত্ব অনেক বেশি।

মানুষ তার জীবনে কতোটা নেক আমল করতে পেরেছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সে তার আমলকে কতোটা বিশুদ্ধ রাখতে পেরেছে। আমল যদি বিশুদ্ধ না থাকে তবে সে আমলের কোনোই মূল্য থাকে না। প্রকৃত মু’মিন তো সে, যে কতোটা বেশি আমল করেছে সেদিকে লক্ষ না করে বরং তার আমলকে কতোটা বেশি বিশুদ্ধ রাখতে পারছে সেটার দিকেই সবসময় খেয়াল রেখে চলে, সেটা নিয়েই তার যতো চিন্তা থাকে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই কম-বেশ নেক আ*মল করি ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের নেক আমলগুলো বিশুদ্ধতার মানদন্ডে উর্ত্তীণ হয় না। কারণ আমাদের আমলগুলোর পিছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পরিবর্তে লোক দেখানোর প্রবণতা থাকে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা মানুষকে নিজেদের আমল বলে বেড়াতে কিংবা মানুষ কেন্দ্রিক আমল করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ফলে আল্লাহর নিকট সেগুলোর কবুল যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, আমলগুলো বরবাদ হয়ে যায়।

মানুষকে দেখানোর আমল করা কতোটা ভয়াবহ তা আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস থেকে জেনে নিই। রাসূল (সাঃ) বলেছেন– ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোটো শিরক নিয়ে যতোটা ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো ব্যাপারে এতোটা ভীত নই’। 

তারা (সাহাবি) বললেন–হে আল্লাহর রাসূল। 

ছোটো শিরক কী? 

তিনি বললেন– রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানো আমল।

আল্লাহ কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান প্রদানের সময় বলবেন– ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে, তাদের কাছে যাও। দেখো, তাদের কাছে তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি-না। [১]

অন্যত্র আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘আমি শরীককারীদের শরীক থেকে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোনো আমল করলো এবং তাতে আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করলো,আমি তাকে এবং যাকে সে শরীক করলো তাকে প্রত্যাখ্যান করি’। [২]

যারা লোক দেখানো ইবাদত করে তাদের নিন্দা করে আল্লাহ বলেছেন,’ধ্বংস সেসব নামাজীর জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে। [৩]

শুধুই কী তাই! রাসূল (সাঃ) লোক দেখানো আমল নিয়ে বলেছেন, যে ব্যক্তি লোক শোনানো ‘ইবাদাত করে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার ‘লোক-শোনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন’। আর যে ব্যক্তি লোক-দেখানো ‘ইবাদাত করবে আল্লাহর এর বিনিময়ে তার ‘লোক দেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন’।[৪] 

যৌবনকাল থেকেই আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে আসছি, প্রতিদিন অল্প করে হলেও কোরআন তেলাওয়াত না করলে আমার ভাল্লাগে না, মাঝে মাঝে নফল সিয়াম পালন করি, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি, আমি সবসময়ই মানুষকে দান করি, বিপদে আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াই, শীত আসলে শীতবস্ত্র বিতরণ করি, প্রতিবার অমুক-তমুককে বেশি করে যাকাত দেই ইত্যাদি বলে বলে আমরা অনেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেই নিজের নেক আমলের এক ধরণের সস্তা প্রচারণা চালাই। আমরা অনেকেই আছি যারা কেউ জিজ্ঞেস করলে তো বটেই এমনকি কেউ জিজ্ঞেস না করলেও নিজেদের নেক আমল গদগদ করে বলে যাই যেনো তারা এগুলো শুনে আমাদের প্রতি খুশি হয়, আমাদেরকে নেক্কার মনে করে।

আপনি কাউকে রক্ত দান করেছেন-সেটা নিঃসন্দেহে ভালো একটি আমল। কী দরকার ফেবুতে এসে রক্ত দানের সংখ্যাসহ সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার? এই আমল গোপন রাখলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেতো আপনার? আপনি হয়তো বলবেন, উৎসাহের জন্য এগুলো প্রচার করছেন। আচ্ছা, নিজেকে একটু জিজ্ঞেস করুন তো, আপনি কি আসলেই উৎসাহের নামে ওগুলো প্রচার করছেন না-কি আপনি চাচ্ছেন মানুষ আপনার এমন আমল দেখে বাহবা দিক, আপনার প্রতি খুশি হোক এবং আপনাকে একজন সৎকর্মশীল হিসেবে জানুক? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। যদি দ্বিতীয় বিষয় হয়ে থাকে তবে ঐ হাদীসের আলোকে নিজের নেক আ*মল বরবাদ করে দিচ্ছেন না তো?

[২]

জীবনে তো আমাদের কতো কিছুই দেখার ইচ্ছা জাগে। কখনো কি আপনার নিজের সৃষ্টিকর্তাকে দেখার ইচ্ছা জেগেছে? যদি সত্যিকার অর্থে আপনার রবের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা জেগে থাকে তবে আপনাকে ঈমান আনার পর ফরজ আমলগুলো ঠিক রাখার পাশাপাশি বিশেষভাবে দুটো কাজ নিশ্চিত করতে হবে, হ্যাঁ দুটো কাজ।

স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন সেই দুটো কাজ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেনো নেক কাজ করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক তথা লোক দেখানোর আমল (রিয়া) না করে’। [৫]

অতএব বুঝতেই তো পারছেন, আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমাদের নেক আমলগুলো বিশুদ্ধতার মানদন্ডে উর্ত্তীণ হতে হবে। অর্থাৎ নেক আমলগুলো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কেন্দ্রিক হতে হবে। অন্যথায়, আমাদের করা নেক আমলের কোনোই দাম থাকবে না, থাকবে না কোনো সার্থকতা। আর সেই তো প্রকৃত হতভাগা যে তার সারাটা জীবনে এতো এতো নেক আমল করেও কেবল তার আমলে ‘রিয়া’ থাকায় নিজেকে আল্লাহর সাক্ষাৎ পাওয়ার উপযুক্ত করে তুলতে পারলো না।

জানেন, নেক আমল গোপন রাখার মধ্যে অন্য রকম এক স্বাদ রয়েছে। নেক আমল গোপন রাখলে আল্লাহ গোপনকারীর অন্তরে এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি করে দেন যা আমল প্রকাশকারীরা কখনোই বুঝতে পারে না। বিশ্বাস করুন, সে এক অন্য রকম মানসিক প্রশান্তি। আপনি যদি সেই অনাবিল প্রশান্তি পেতে চান তবে আপনি নিশ্চিত করুন, আপনার নেক আমলগুলোকে আপনি গোপন রাখছেন। অর্থাৎ মানুষকে বলে বেড়াচ্ছেন না কিংবা মানুষকে দেখানোর জন্য করছেন না। তবেই আপনার মধ্যে অন্যরকম এক ফিলিংস কাজ করবে।

রেফারেন্সঃ

[১] মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ২২৫২৮

[২] সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং : ৩৫২৮

[৩] সূরা আল মাউন, আয়াত নং : ৪-৭

[৪] সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৭১৫২

[৫] সূরাকাহাফ, আয়াত নং : ১১০

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment