দুমুখো মানবিকতা

Spread the love

 [এক]
কথায় আছে হাতি মরলেও লাখ টাকা বাঁচলেও লাখটাকা। মানুষের জীবন আর কত টাকা? ইন্ডিয়ায় এক হাতিকে আনারসের মধ্যে পটাকা তথা বাজি দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তিতে জানা যায় হাতিটি সন্তান সম্ভাবা ছিল। সন্তান সম্ভাবা একটি হাতিকে গোলাবারুদ দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই নৃশংসতম কাজ। ফলে ফেসবুকে এক প্রকার আম্পান বয়ে গেল। সকলেই ট্রেন্ডি হয়ে শোক প্রকাশ করলো।

এর সমসাময়িক ঘটনা কিছু ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। একই দেশে এক অন্তসত্ত্বা বোন সাফুরা যারগার জেল খানায় বন্দী। কারণ সে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরোধিতা করেছিল। এই অবস্থায় তার ঝুঁকির কথা চিন্তা করে জামিন আবেদন করলে সেই আবেদন নাকচ করে দেয় মানুষের তৈরি পক্ষপাতদুষ্ট বিচার ব্যবস্থা তথা আদালত। সেই বোনও অন্তসত্বা কিন্তু সে মানুষ সে তো আর হাতি না যে তাকে নিয়ে সোশাল মিডিয়া গরম করতে হবে। তাছাড়া তার পরিচয় সে একজন মুসলিম।

সারা বিশ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, হাতির রক্তের দাম আছে কিন্তু মুসলমানের রক্তের দাম নেই। ফিলিস্তিন, চীন, পাশের দেশ ভারত এবং মিয়ানমারসহ সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে মুসলিমদের উপর অমানবিক অত্যাচার। যে অত্যাচারের কাছে সূর্যের রক্তিম বর্ণও মলিন দেখায়। কিন্তু এই বিষয়গুলো জাতিসংঘ বাঁ মানবিকতার মুখোস পরিহিত অদ্ভুদ মানুষ গুলোর চোখে পরে না। এ নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করে কারণ তারা মুসলিম।

একই সময়ের আরেকটি ঘটনা হচ্ছে মানবপাচারকারীরা ১৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করলো কিন্তু সেটা নিয়েও তেমন একটা কথা হল না। কি অদ্ভুদ তাই না? মানুষ তার স্বজাতির ব্যাথায় ব্যথিত নয়। তারা ব্যাথিত হয় হাতি হত্যায়। অবশ্যই হাতির সাথে যেটা ঘটেছে সেটার জন্য ব্যথিত হওয়া স্বাভাবিক আরও বেশি স্বাভাবিক বাঁ প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ ছিল নিজের স্বজাতির ব্যথায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তারা ব্যথিত হয়না। কেন?

আসলে মানুষের মস্তিষ্ক এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে, মানব হত্যা দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। নতুন কিছু যেমন হাতি হত্যা তাদের কাছে নতুন মনে হয়েছে তাই হাতি হত্যা নিয়েই বেশি মাতামাতি করেছে। ভাবুন কততা নিচে নেমে গেলে মানব হত্যা স্বাভাবিক মনে হয় আর পশু হত্যাকে মানব হত্যার চেয়ে উর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়? এই হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাতের অধঃপতনের চিত্র।

[দুই]
গতকালের কথা, সাবেক স্বাস্থমন্ত্রী মারা গেলেন, তিনি ব্যক্তি জীবনে কেমন ছিলেন সেটা আমরা সবাই জানি। নতুন করে বলার কিছুই নেই। ক্ষমতার লোভ মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। ক্ষমতালোভী মানুষের হিতাহিত জ্ঞান বলে কিছুই থাকে না, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেটা তারা অনেক ক্ষেত্রে বুঝেও বুঝে না অথবা বুঝলেও ব্যাক্তি বাঁ দলীয় স্বার্থের জন্য সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ফলাফল আমাদের চোখের সামনে।

তাকে নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়া গরম হয়েছে। দুদলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেছে। কেউ বলেছে জানাযা দেয়া যাবে না, কেউ বলেছে ভাই মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কটুক্তি বাঁ গালাগাল দেয়া যাবে না কেননা তারা তাদের কর্মফল প্রাপ্তির স্থানে পৌছে গিয়েছে। এখানেও অনেকে দলীয় স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, তার হয়ে সাফাই গেয়েছে। আবার অনেকে এখানেও মানবিকতা খুজেছে। একজন ব্যাক্তি মারা গিয়েয়ে তাকে জানাজা দেয়া যাবেনা এতটা অমানবিক মানুষ কীভাবে হতে পারে?

[তিন]
কিন্তু আমার কষ্টের কারণ হচ্ছে, গতকাল আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। লক্ষিপুরে ৯ম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে (হিরা মণি) ধর্ষন করা হয়েছে। ধর্ষন করেই এই নরপিশাচের দল ক্ষ্যান্ত হয়নি, শ্বাসরোধ করে মেয়েটাকে হত্যাও করেছে। বলাবাহুল্য মেয়েটির বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুর সাথে প্রাণপণে লড়ছে ঢাকার কোন একটি হাসপাতালে। এজন্য মেয়েটির মা মেয়েটিকে বাড়িতে একা রেখে ঢাকা এসেছিল নিজের স্বামীর দেখাশোনা করতে।

নিজেকে সেই মায়ের যায়গায় কল্পনা করুন তো। স্বামী এই অবস্থা কাটতে না কাটতেই এভাবে হারাতে হয়েছে তার মেয়েকে। সেই মায়ের বুকের উপর কত বড় পাথর চাপা দেয়া হয়েছে ভাবতে পারেন? কীভাবে তিনি এই বেদনা সহ্য করছেন আল্লাহ্‌ ভালো জানেন। মহান আল্লাহ্‌ তাআলা সেই মাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন।

সেই মাকে নিয়ে সেই বোনকে নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্যই হয়নি। কিন্তু স্বাস্থমন্ত্রীকে নিয়ে অনেকেই মানবিকতার বুলি ছেড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় মানবিকতা শুধু এলিট ক্লাসের জন্য। গরিবের জন্য মানবিকতার কোন স্থান এই পৃথিবীতে নেই।

এই মানবিকতার বুলি আওরানো মানুষগুলোকে মাঝে মাঝে দুমুখো সাপ মনে হয়, যে কিনা দু দিকেই কাটে। কারণ তাদের মানবিকতার মুখোস ভারতের সেই অন্তসত্ত্বা বোন বা লক্ষিপুরের ধর্ষিত বোনের বেলায় থাকে না। তখন হয়ত তারা সেই মানবিকতার মুখোস খুলে কাঠের চশমা পরিধান করে থাকে।

[চার]
আজ একজন অভিনেতা মারা গিয়েছে। বলাইবাহুল্য, তার মৃত্যু স্বাভাবিক কোন মৃত্যু ছিলনা। সে আত্মহনন করেছে, নিজেকেই নিজে হত্যা করেছে। মৃত্যুর পরপর আমার মনে হয়েছিল, বিনা টিকেটে বোধহয় ভারতে চলে এসেছি। ওপারে ভালো থাকবেন, রেস্ট ইন পিস জাতীয় লেখায় ফেসবুক উলপ পালট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি আত্মহত্যা মহাপাপ।

সে যদি একজন মুসলিমও হতো তাহলেও সে যেভাবে আত্মহত্যা করেছে অনন্তকাল ধরে সেভাবেই আত্মহত্যা করতে থাকবে (বুখারি)। কিন্তু আদতে সে মুসলিম নয় তাকে নিয়ে যা হয়েছে সেটা বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে আমার কাছে।

[পাঁচ]
যাই হোক আমার আলোচনার বিষয় এটা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অভিনেতার কি দুনিয়াবি অর্থসম্পদ, নাম, যশ, খ্যাতি কম ছিলো? অবশ্যই না। আসলে যে মানুষের এতকিছু থাকার পরেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়, আর যাই হোক তার মনে সুখ বা শান্তি নেই। হয়ত আপনি দুনিয়ার অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারেন কিন্তু আপনি কখনও সুখি হতে পারবেন না যতক্ষণ স্রষ্টার সান্নিধ্যে আসেন।

মহান আল্লাহ্‌ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, “যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের মন প্রশান্ত হয় জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই মন বা অন্তর প্রশান্ত হয়”। সূরাঃ আর রা’আদ, আয়াতঃ ২৮।

সব কথার বড় কথা সুখ জিনিসটা পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক। আপনি তিন বেলা কোন রকমে খেয়ে যদি আল্লাহয় শোকর গুঁজার করেন তাহলে আপনি সুখী। আবার আপনার দশ তলা বাড়ি থাকার পরও যদি আল্লাহর শোকর না করেন আপনি সুখী হতে পারবেন না।

আর একটা কথা আপনার যা আছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। শুকরিয়া আদায় করতে হবে। যতক্ষণ আপনি আপনার যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না ততক্ষণ আপনি সুখী হতে পারবেন না। এজন্য আমি বলি Let’s make a habit of saying ALHAMDULILLAH.

যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন অবস্থায় আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেয়ে পরে বেঁচে আছি এই কম কিসে? এজন্যই তো মহান রবের কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করা যায়। বলা যায় আলহামদুলিল্লাহ।

|| দুমুখো মানবিকতা ||
© সাবেক কিংকর্তব্যবিমূঢ়

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment