কোরবানির গোশত কোরবানিদাতার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিলি-বণ্টন করা ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ। নববী যুগ থেকেই এ পদ্ধতি চলে আসছে। সামাজিকভাবে সমাজপতিদের নেতৃত্বে কোরবানির গোশত বণ্টনের কোনো দৃষ্টান্ত সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের পুণ্যময় যুগে পাওয়া যায় না। তার পরও নতুন চালু হওয়া এ সামাজিক বণ্টন-প্রথা বেশ গুরুত্বের সাথে দেশের বহু এলাকায় পালিত হচ্ছে।
সামাজিক বণ্টনের ধরণ :
কোরবানির গোশতের প্রচলিত সামাজিক বণ্টনের ধরণ, স্থানভেদে সামান্য ভিন্নতার সঙ্গে অনেকটা এমন- প্রত্যেক কোরবানিদাতা তার কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ মসজিদে দিয়ে আসেন। মসজিদ কমিটির নেতৃত্বে সবার জমাকৃত গোশত সমাজের ধনী-গরীব সকলের মাঝে সমান করে বণ্টন করা হয়।
এ পদ্ধতির একটাই মাত্র সুবিধা, তা হলো- কোরবানিদাতার বাড়িতে ভিক্ষুকদের ভিড় থাকে না এবং সমাজের সকল গরীবের গোশত প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। এ সুবিধাটির কারণেই সমাজপতিরা উক্ত পদ্ধতিকে পছন্দ করে থাকেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে বেশ কিছু শরয়ী সমস্যা রয়েছে। একারণে এ ধরনের পদক্ষেপ মূলত ভালো নিয়তে ভুল পদক্ষেপ বলে গণ্য। আর শুধু নিয়ত ভালো হলেই কাজ ভালো হয় না। ভালো কাজ সেটাই যার পদ্ধতিটিও সঠিক।
প্রচলিত সামাজিক-প্রথার শরয়ী সমস্যাবলী :
সামাজিকভাবে কোরবানির গোশত বণ্টন-প্রথাটি অনেকগুলো কারণে শরীয়তসম্মত নয়। সেগুলোর অন্যতম হলো-
১. ব্যক্তিগত আমলকে সম্মিলিতরূপ দেওয়া :
প্রচলিত গোশত বণ্টন-পদ্ধতির মাধ্যমে একটি ‘ইনফিরাদী’ তথা ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনযোগ্য আমলকে সম্মিলিত রূপ দেওয়া হয়। কেননা কোরবানী একটি ব্যক্তিগতভাবে আদায়যোগ্য আমল। ঈদের দিন সম্মিলিতভাবে জামাতে নামায আদায় করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোরবানির পশু কোথায় জবাই করবে, গোশত কিভাবে বন্টন করবে এ বিষয়গুলো শরীয়ত সম্পূর্ণরূপে কুরবানীদাতার ইচ্ছা ও স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দিয়েছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে একত্রিত হতে বলেছেন। কিন্তু কোরবানির পশু জবাই করার জন্য কোনো বিশেষ স্থান নির্ধারণ করেননি বা সবাইকে বিশেষ কোনো স্থানে একত্রিতও হতে বলেননি। গোশতের ব্যাপারে বলেছেন, নিজে খাও, অন্যকে খাওয়াও, দান করো এবং ইচ্ছা হলে কিছু সংরক্ষণ করো।
তিনি সাহাবায়ে কেরামকে একথা বলেননি যে, তোমরা গোশতের একটি অংশ আমার কাছে নিয়ে আসো আমি তা বণ্টন করে দিবো কিংবা এই আদেশও দেননি যে, তোমরা নিজেদের এলাকা ও মহল্লার কোরবানির গোশতের একটি অংশ একস্থানে জমা করবে এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তা বণ্টন করবে।
আর এভাবে কোনো ব্যক্তিগত পর্যায়ের আমলকে মনগড়া সম্মিলিতরূপ দেওয়া শরীয়তসম্মত নয়।
২. শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত করা :
এ ধরনের ব্যবস্থাপনার দ্বারা শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। কেননা শরীয়ত তো বিশেষ উদ্দেশ্যেই কোরবানির এ আমলটিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেছে।
৩. ঐচ্ছিক বিষয়কে অপরিহার্য বানানো :
কোরবানির গোশত আদৌ বিতরণ করা হবে কি-না, বিতরণ করা হলে কতটুকু অংশ বিতরণ করা হবে তা সম্পূর্ণ কোরবানিদাতার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি তার কোরবানীর গোশত কী পরিমাণ নিজে রাখবেন, কী পরিমাণ অন্যকে খাওয়াবেন, কী পরিমাণ সদকা করবেন এবং কী পরিমাণ আগামীর জন্য সংরক্ষণ করবেন এগুলো সম্পূর্ণ তার ইচ্ছাধীন। শরীয়ত তাকে কোনো কিছুতেই বাধ্য করেনি।
এজন্য যে কোরবানীদাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি তিনি যদি সব গোশত তার পরিবারের জন্য রেখে দেন তবে শরীয়তে এটারও সুযোগ রয়েছে। অবশ্য গরীব-মিসকীন ও পাড়া প্রতিবেশীকে সামর্থ্যানুযায়ী দান করাও মানবতা ও ঈমানের দাবি। আবার যার সামর্থ্য আছে তিনি যদি অল্প কিছু গোশত নিজেদের জন্য রেখে বাকি সব গোশত দান করে দেন তবে এটাও ভালো কাজ।
মোটকথা, কোরবানীর গোশত দান করার বিষয়টি শরীয়ত সম্পূর্ণভাবে কোরবানীদাতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে। এখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ অনুমোদিত নয়। এবিষয়ে কারো বাধ্যবাধকতা আরোপের কোনো অধিকার নেই। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক বণ্টন পদ্ধতিতে সমাজপতিরা কোরবানিদাতার এ ঐচ্ছিক অধিকারটি হরণ করে।
৪. অংশগ্রহণ না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া :
কোরবানীর গোশতের নির্ধারিত একটি অংশ সামাজের জন্য দিতে সকল কোরবানীতাকে মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে বা বাধ্যবাধকতার পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বাধ্য করা হয়। তাই কোথাও কোথাও গোশত না দিলে সমাজচ্যুত করার হুমকিও দেওয়া হয়। আবার কোথাও জোরালো কোনো হুমকি না থাকলেও সমাজের লোকদের বাঁকাদৃষ্টি ও তীর্যক মন্তব্যের ভয়ে সমাজপতিদের নির্ধারিত অংশ দিতে কোরবানিদাতা বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন। যা আল্লাহ তাআলা বাধ্যতামূলক করেননি; বরং ঐচ্ছিক রেখেছেন সমাজ ও সমাজপতিরা তা বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে।
৫. স্বাধীন বিবেচনা বাঁধাগ্রস্ত করা :
অনেক মানুষ নিজেদের বিবেচনামতো কোরবানীর গোশত নানাজনকে হাদিয়া কিংবা সদকা করতে চান। পরিচিত কোনো গরীব-মিসকিন বা আত্মীয়-স্বজনকে অন্যদের তুলনায় হয়তো একটু বেশি দিতে চান। কোরবানী যেহেতু ব্যক্তিগত ইবাদত তাই গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রেও কোরবানীদাতার উক্ত ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধ অনুযায়ী কাজ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সামাজিক রীতি অনুযায়ী কাজ করতে হয়। নিজের স্বাধীন বিবেচনামতো করতে পারেন না।
কেউ বলতে পারে, কোরবানিদাতা তো অনেক সময় কোনো চাপ প্রয়োগ ছাড়াই নিজে থেকে সমাজে গোশত দিয়ে থাকে। তাই তা হাদিয়া বা সদকা হিসেবে গণ্য হবে। এ যুক্তি ঠিক নয়। কেননা হাদিয়া বা উপহার তো সেটাই যা সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেয়া হয়। যাতে কোনো সামাজিক চাপ কিংবা প্রথাগত বাধ্য-বাধকতা থাকে না। অন্যথায় তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন,
ألا ولا يحل لامرئ من مال أخيه شيء إلا بطيب نفس منه.
‘সাবধান! কারো জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি না থাকে।’
[মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৪৮৮; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস : ২৮৮৩; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস : ৫৪৯২]
অর্থাৎ কেউ কিছু দিলেই তা ভোগ করা হালাল হয় না, যে পর্যন্ত না সে তা খুশি মনে দেয়। কোনো ক্ষেত্রই এ বিধানের বাইরে নয়। সুতরাং কেউ যদি বাধ্য হয়ে প্রথাগত কারণে নিজের কোরবানির গোশত সমাজের জন্য দেয় তবে তা গ্রহণ করা কারো জন্যই বৈধ নয়। তাহলে সমাজপতিদের পক্ষ থেকে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ গোশত বাধ্যতামূলক দাবি করা হয় তবে তা কীভাবে বৈধ হবে? এ তো হাদিয়া বা সদকা নয়, সরাসরি পরস্বহরণ।
অতএব কোরবানির গোশত বণ্টনকে সামাজিক রূপ দেওয়া শুদ্ধ নয়।
৬. হাদিয়া বা সদকা গ্রহণে বাধ্য করা :
অনেক মানুষ আছেন যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সব মানুষের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক রীতির কারণে প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য, এই ধরনের বাধ্যবাধকতাহীন বিষয়াদিতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেই দুরস্ত নয়।
৭. গোশত প্রদানে মনগড়া শর্ত আরোপ করা :
অন্য সমাজের মসজিদে নামায পড়লে কোরবানির গোশতের ভাগ না দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় কোথাও কোথাও।
অথচ কোরবানির গোশত প্রদানে ইসলাম কোনো শর্ত রাখেনি। এমনকি অমুসলিমদেরও কোরবানির গোশত দেওয়ার অনুমতি ইসলামে আছে। ইসলাম যা নিঃশর্তে প্রদান করতে বলেছে, তা প্রদানের জন্য নিজেদের মসজিদে নামায পড়ার শর্ত দেওয়ার অধিকার সমাজপতিদের নেই।
৮. হাদিয়া দেয়ার পর কিছু অংশ ফিরিয়ে নেয়া :
প্রচলিত বণ্টন পদ্ধতিতে সমাজের সবাইকে গোশতের ভাগ দেওয়া হয়। যারা কোরবানী করেনি তাদেরকে দেওয়া হয়, আবার যারা কোরবানী করেছেন তাদেরও দেওয়া হয়। ফল দাঁড়াচ্ছে, সমাজের জন্য গোশত দেওয়ার পর তার কিছু অংশ কোরবানিদাতারা ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অথচ কাউকে কোনো কিছু দেওয়ার পর ফিরিয়ে নেওয়া একটি ঘৃণিত কাজ, নিকৃষ্ট স্বভাব। হাদিসে এর উপমা দেওয়া হয়েছে নিজের বমি নিজেই খাওয়ার সাথে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ﻻ ﻳﺤﻞ ﻟﺮﺟﻞ ﺃﻥ ﻳﻌﻄﻲ ﻋﻄﻴﺔ، ﺛﻢ ﻳﺮﺟﻊ ﻓﻴﻬﺎ، ﻓﻤﺜﻠﻪ ﻣﺜﻞ اﻟﻜﻠﺐ ﺃﻛﻞ ﺣﺘﻰ ﺇﺫا ﺷﺒﻊ ﻗﺎء، ﺛﻢ ﻋﺎﺩ ﻓﻲ ﻗﻴﺌﻪ.
‘কোনো ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় কাউকে কিছু দান করার পর তা ফিরিয়ে নেওয়া। এর দৃষ্টান্ত হলো, কুকুরের মতো। কুকুর যখন খেতে খেতে পরিতৃপ্ত হয়ে যায়, তখন সে বমি করে। কিছুক্ষণ পরে নিজেই আবার নিজের সেই বমি চেটে চেটে খায়।’ [মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ২২১৩১]
৯. গরীবের প্রাপ্যাংশ ধনীদের দেওয়া :
কোরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব। এক ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা। আরেক ভাগ গরীবদের মাঝে বিলি করা, আর অপর ভাগ আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের মাঝে বিলি করা। প্রচলিত সামাজিক বণ্টনে যারা কোরবানির গোশত সমাজে জমা দেয় তারা কিন্তু গরীবের ভাগটাই সেখানে জমা দেয়। যার জন্য বাড়িতে কোনো গরীব, মিসকীন বা ভিক্ষুক আসলে তাদের সোজা বলে দেয়, গরীবের ভাগ আমরা মসজিদে দিয়ে দিয়েছি। অথচ মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সমাজপতিরা কোরবানির গোশতে গরীবদের সেই ভাগটুকু সমাজের ধনী, গরীব, স্বচ্ছল, অস্বচ্ছল নির্বিশেষে সবাইকে দেয়। এটা গরীব লোকদের প্রাপ্যতা নষ্ট বা হ্রাস করার শামিল।
১০. অন্য মহল্লার গরীবদের গোশত না দেওয়া :
সাধারণত প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে অনেক পাড়া, মহল্লা এমন থাকে যেখানকার বেশিরভাগ লোকই কোরবানী দেয় না। মহল্লাবাসীর অধিকাংশই দরিদ্র, দিনমজুর। কিন্তু পাশের মহল্লায়, গ্রামে অনেকেই কোরবানী দেয়। আগে এ ধরনের মহল্লার দরিদ্ররা কোরবানীর দিন আশ-পাশের পাড়া-মহল্লার কোরবানীদাতাদের বাড়িতে যেত। সবার থেকে কিছু কিছু গোশত পেত। যাতে তাদের দু’এক দিনের খাবার অনায়াসেই চলে যেত। পরিতৃপ্ত হয়ে তারা গোশত খেত।
কিন্তু সামাজিক বণ্টন প্রথার রেওয়াজ তাদের গোশত খাওয়ার এ সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তারা পাশের মহল্লার কোরবানিদাতাদের বাড়িতে গেলে গোশত পায় না। কোরবানিদাতা উত্তর দেয়, গরিবের ভাগ মসজিদে দিয়েছি। তোমরা মসজিদে যাও। আর মসজিদে গেলে সমাজপতিরা তাদের উত্তর দেয়, খাতায় তোমাদের নাম নেই। তোমরা এ সমাজের নও। তোমাদেরকে আমরা গোশত দিতে পারবো না।
১১. গোশত কাটাকাটির জন্য মসজিদের বারান্দা ব্যবহার করা :
অনেক এলাকায় গোটা সমাজের কোরবানীর গোশত কাটা এবং তা বণ্টনের বন্দোবস্ত করার জন্য উপযুক্ত জায়গা থাকে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই কারো বাড়ির আঙ্গিনা বা বাংলা ঘর ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতি বছর বাড়ির মালিক তার বাড়িতে এসব কাজকর্ম করার জন্য খুশিমনে অনুমতি দিবেন এমনটি নাও হতে পারে। অনেক সময় তো এই নিয়ে ঝগড়া-বিবাদও হতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্থানে তো এমন কাণ্ড করা হয় যে, কোনো উপযুক্ত জায়গা না থাকায় মসজিদের মধ্যে এই কাজ আরম্ভ করা হয়- নাউযুবিল্লাহ। এর দ্বারা মসজিদের সম্মান ও পবিত্রতা কী পরিমাণ বিনষ্ট হয় তা তো খুব সহজেই অনুমেয়।
১২. অন্যের গীবত-শেকায়েতের দ্বার উন্মুক্ত করা :
এ ধরনের সামাজিক প্রথার আরেকটি ক্ষতি হলো, সমাজের লোকজনের মধ্যে একটি গুঞ্জন সৃষ্টি হয় যে, অমুকের সম্পদ সন্দেহজনক, অমুকের আয়-রোজগার হারাম, কিন্তু তার কোরবানির গোশতও সবাইকে খেতে হচ্ছে! ইত্যাদি। এখন এ জাতীয় কথাবার্তা শুধু অনুমান নির্ভর হোক বা বাস্তবভিত্তিক উভয় ক্ষেত্রেই এ ধরনের আলোচনা-সমালোচনা দ্বারা সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এর দ্বারা একদিকে যেমন সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যদিকে কুধারণা ও গীবত-শেকায়েতের গুনাহে লিপ্ত হতে হয়।
তাছাড়া বাস্তবিকই যদি সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে যাদের আয়-রোজগার হারাম পন্থায় হয় তাহলে সেক্ষেত্রে জেনেবুঝে তাদের কোরবানির গোশত সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যে একটি গুনাহর কাজ তা তো বলাই বাহুল্য। এ ধরনের কোরবানির গোশত হাদিয়া হিসেবে বণ্টন করা এবং ব্যবহার করা কোনোটাই জায়েয নয়।
১৩. গোশত গ্রহণ ও বণ্টন পদ্ধতিতে সমস্যা :
যেসব অঞ্চলে ‘সমাজ’ প্রথা চালু আছে সেসব অঞ্চলের সর্বত্র গোশত গ্রহণ ও বণ্টনের পদ্ধতি এক নয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই কাজ করা হয়। প্রত্যেক পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও আপত্তিকর বিষয় বিদ্যমান রয়েছে। সবগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কেননা উপরোল্লেখিত আপত্তিগুলোই এই মূল পদ্ধতি বর্জণীয় হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
যদি প্রচলিত এই প্রথায় ভিন্ন কোনো সমস্যা না-ও থাকে তবুও এই সমস্যা তো অবশ্যই আছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে যে বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ ছিল এবং কোরবানীদাতার ইচ্ছা- স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তাতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এই মৌলিক সমস্যাই উপরোক্ত প্রথা আপত্তিকর ও বর্জণীয় হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
সারকথা, উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক প্রত্যেককে তার কোরবানির বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। কোরবানিদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনামতো যাকে যে পরিমাণ হাদিয়া করতে চায় করবে এবং গরীব মিসকীনকে যে পরিমাণ সদকা করতে চায় করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় থেকে শত শত বছর যাবত এ পদ্ধতি চলমান ছিল এবং এখনও সুন্নতের অনুসারী আলেম ওলামা ও দ্বীনদার মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতিই চালু রয়েছে।
আর এ পদ্ধতিই অবলম্বন করা জরুরী। বিশেষত এই ফিতনার যুগে নানামুখী ঝামেলা ও মনোমালিন্য থেকে মুক্ত থাকার এটিই একমাত্র পন্থা এবং স্বাভাবিকভাবে সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষজনও এই পন্থা গ্রহণ করতে চান।
পরিশেষে বলবো, জুমআ ও ঈদের দিন মসজিদ ও ঈদগাহে ইমাম এবং খতীব সাহেবদের এ বিষয়টি মানুষকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শরীয়তের আহকাম সঠিকভাবে বোঝার এবং আন্তরিকভাবে তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লিখেছেনঃ মাহমুদ আমান