দায়িত্বের পালাবদল [চমৎকার একটি শিক্ষণীয় গল্প]

Spread the love

 আগে দুপুরে আম্মুকে বেশ বকার সুরেই বলতাম, এতো দেরি করে কেনো যোহরের সলাত পড়ো বলোতো? আরও আগে আগে চেষ্টা করবে।
ওদিকে খেয়াল করতাম আম্মু চাইলেও যেন কাজ শেষ হতো না, একটার পর একটা লেগেই থাকতো।

আজ আমিই যেন ঘড়ির কাটার সাথে পেরে উঠছি না! জায়নামাজে দাড়িয়ে দেখি ২ টা বেজে গেছে, মনে পড়ে গেলো আম্মুকে বলা কথাটা।
‘আরও আগে সলাত পড়তে পারো না…?’

আজ আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, দায়িত্ব, কাজ সেরে সবকিছু ঠিক রাখা কতটা কঠিন।

আম্মুর চুলগুলোকে দেখতাম একদম অগোছালো, জট পেকে থাকতো।
কতবার যে বলেছি, গোসল করার সময় শ্যাম্পু দিয়ে সময় নিয়ে আঁচড়ে আসবে, এতো দ্রুত গোসল করে বেরিয়ে পড়ো কেনো? সময় নিয়ে করতে পারো না? আম্মু তাও তাড়াহুড়ো করে এক বালতি কাপড় ধুয়ে কোনো রকমে গোসল সেরে বেরিয়ে পড়তো।

আজ ৭/৮ টা জামা কাপড় ধোয়ার পর নিজের চুলে শ্যাম্পু দেওয়ার কথাই মনে নেই আমার, ওদিকে দ্রুত গোসল করে বেরিয়ে পড়তে হবে যে! চুলায় রান্না করা শেষ হলেও নতুন বাবা মা’কে বেড়ে দিতে হবে খাবার, উনিও অফিস হতে দুপুরের খাবার খেয়ে যাবেন। কত কাজ! এখন কি দেরি করে গোসল করলে চলে? কয়েক মগ পানি ঢেলে, গা মেজে, বালতি তে করে ধোয়া জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পরি।

বারান্দায় জামা কাপড় নাড়তে নাড়তে দেখলাম, ছোট্ট একটা মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে। কত শত প্রশ্ন ছোট্ট মেয়েটার!
মেয়েটা জিজ্ঞেস করছে, “আম্মু কোথায় যাচ্ছি আমরা, আমায় চকলেট দিবে তো? আমার কয়েকটা রঙিন কাগজ লাগবে, ফুল বানাবো”

মা তার মেয়েকে নিয়ে দ্রুত হেটে হেটে বলছে, “এইতো মা, সব দিবো। এখন জলদি চলো দেরি হচ্ছে যে! দেরি করলে সব কাজ পঁচা হয়ে যাবে না? টিচার বকবে”

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের কথা শুনছিলাম আর দেখছিলাম তাদের চলে যাওয়া।
হঠাৎ শুনতে পেলাম পেছন হতে আম্মুর কন্ঠ!
“কিরে আইশা জলদি কাপড় গুলো নেড়ে রান্নাঘরে যা! দেরি করে ফেলছিশ তো”

বুকটা কেমন চিপ মেরে ধরলো, কিন্তু তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পরিস্থিতি আমাকে ভুল শুনিয়েছে তার মানে।
তড়িঘড়ি করে দায়িত্বের কাছে চলে যাই আমি।
.
.

আজ বহুদিন পর ড্রেসিং টেবিলের চকচকে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে আছি,
চুলগুলো একদম আম্মুর মতো অগোছালো হয়ে আছে, তেল লাগাই নি, গোসল করার সময় শ্যাম্পুটাও দেইনি। আম্মুকে কত বকতাম এসবের জন্য, আজ নিজের দিকে তাকিয়ে আমার কথাগুলোর জন্য বেশ হাসিই পাচ্ছে।

ইশশশ যদি আম্মুটাকে তখন কাজে আরও বেশি বেশি সাহায্য করে দিতাম। নিজ থেকে জোড় করে তেল লাগিয়ে, চুল আঁচড়ে দিতাম।

হঠাৎ খেয়াল করলাম, একদমই সময় নেই আমার! আবার হাটা শুরু করলাম দায়িত্বের কাছে।
.
.

আজ খানিকটা বিরক্ত হয়ে আছি। উনাকে কতবার বললাম নাস্তা বানিয়েছি, খেয়ে এরপর নাহয় আরেকবার ঘুমান। কিন্তু না! উনি ঘুমিয়েই আছে।
নাস্তা গুলো কয়বার গরম করবো আমি? আরও বাকি দুজনের জন্য এই নিয়ে ২/৩ বার গরম করা হয়ে গেছে। চা ৩/৪ বার গরম করে দিলে এটার স্বাদ বলতে আর কিছু থাকে?

হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আম্মুর কথা। কি ঘুমটাই না দিতাম ফজরের পর! আম্মু কতবার বলতো, নাস্তা বানিয়েছি খেয়ে নাহয় ঘুমা।
কিন্তু আমি! মানলাম নাহয় খুব ঘুম পেতো, কিন্তু বারবার আম্মুর নাস্তা গরম করতে কি কষ্টটাই না হতো! বুঝতে পারছি, আজ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি।
.
.

আগামীকাল ইদের দিন, কত যে কাজ আমার। একদিকে আনন্দ আরেকদিকে ভয়! সব পারবো তো ঠিক মতো করতে।
পাশের বাসার একটা মেয়ে এলো সন্ধ্যার পরে, নাম ইনায়া , ক্লাস নাইনে পড়ে।
হাসিটা মুখ জুড়ে থাকে তার, কত আবদার করে আমায়, কিন্তু সব আবদার রাখার ফুরসত কই আমার? মনটাও খারাপ হয়ে যায় মেয়েটার।

আজ এসে আমায় বললো, “এই যে আমার আপু! মেহেদী লাগাও নি তুমি এখনো? এসো তোমাকে মেহেদী লাগিয়ে দিবো, এই যে দেখো আমি এক দফা লাগিয়ে ফেলেছি অলরেডি!  এসো না তোমাকেও লাগিয়ে দিবো”

ইচ্ছে করছিলো খুব চাঁদরাতে মেহেদী লাগিয়ে আগের দিনগুলো মনে করতে, কিন্তু কিভাবে! মেহেদী হাতে লাগিয়ে বসে থাকলে কাজ গুলো সারবে কে? বুট ভেজানো বাকি, গোশত গুলো টুকরো করা বাকি আরও কত কি!

ইনায়াকে বললাম, “কাজ আছে রে! কি করে এখন মেহেদী লাগাই বল। সময় পেলে নাহয় তোকে জানাবো? এসে আমায় মন ভরে মেহেদী লাগিয়ে দিশ”

দেখলাম মনটা সামান্য খারাপ হয়ে গেছে মেয়েটার। কিন্তু কি করবো আমি? আমার সাথে যে এখন এসব যাচ্ছে না।
ইনায়া মন খারাপ করে চলে গেলো বাসায়।

আমার ঠিক একই রকম আরেকটা দৃশ্যের কথাই মনে পড়ছে।
সেবার আমি মেহেদী নিয়ে এসে আম্মুকে কতবার যে বলেছি, আম্মু দাও না তোমার হাতদুটো, মেহেদী লাগাবো, সামান্যই তো।
আম্মু বলতো, না রে এখন তো পারবো না। হাতে কত কাজ! মেহেদী লাগিয়ে কি করে করবো বল। পরে নাহয় দেখা যাবে।
ঠিক ইনায়ার মতো আমিও অভিমান করে এভাবে হেটে চলে যেতাম।

অভিমানগুলো একই থেকে যায়, কেবল মানুষ আর দায়িত্বের পালাবদল ঘটে তাই না?
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে করতে দেখি উনি এসেছেন, ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে।
এটা রাঁধবে কালকে, ওটা রাঁধবে কত আবদার, ঠিক আব্বুটা যেমন আম্মুকে করতো।
.
.

এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে সকাল হতে আজ, ইদের দিন তো বটেই তার উপর আজ আব্বু আম্মু আসবে আমার শশুড়বাড়িতে। আমায় দেখতে, কতদিন পর গল্প করবো তাদের সাথে সামনাসামনি! ইচ্ছে করছে সবটুকু মায়া নিয়ে রান্নাগুলো করি।
আচ্ছা আর কি করলে খাবারের স্বাদ আরও অমৃত হবে? ইউটিউব ঘেটে ঘেটে কত রেসিপি যে দেখে ফেললাম! আজ যে আমার আব্বু আম্মুও নতুন ঘরে আমার রান্না চেখে দেখবেন!

একজোড়া মায়া ভরা চোখ আরেক জোড়া সদ্য দায়িত্ব নেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এক বুক মমতা নিয়ে।
“কি রে মা! খাওয়া দাওয়া করিশ না নাকি? কত শুকিয়ে গেছিশ!”
বললাম, “করি তো আম্মু, কিন্তু মোটা হইনা, এসো রুমে গিয়ে বসবো”

নাস্তা নিয়ে সবাইকে বেড়ে দিলাম। মজার সাথে খাচ্ছে সবাই, আম্মুকে দিতে গিয়ে দেখলাম প্লেটের সাথে আমার হাতটা ধরে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আইশা, মেহেদী দিশ নি?”

উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম শুধু। কারন উত্তরটা আম্মুর জানা, আমারও জানা!
আম্মুও তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মেয়েটা আমার কত বড় হয়ে গেছে আজ!
বললাম, ” হয়েছি তো! দেখো তো, তোমার মতো লাগে কিনা দেখতে”
.
.

ঘোমটার নিচে এলোমেলো চুল ঠিকই আম্মুর নজরে পড়েছে, আর তাই এখন আমাকে বসিয়ে মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছে।
ওদিকে শাশুড়ী মা’কে আমার সামনে বসিয়ে তার মাথায় আমি তেল লাগিয়ে দিচ্ছি।
কাজ সেরে আজ আমার দুই মায়ের কুঁচকানো হাতগুলোয় মেহেদী লাগয়ি রাঙা করে দিয়েছি। কি এক অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! এখন আবার আমার দু-হাত টেনে দুজন মিলে দুটো মেহেদী দিয়ে যা পারছে তা-ই আঁকছে। মন্দ লাগছে না!
ইশশ ভুলেই গেলাম, ছোট্ট মেয়ে ইনায়ার কথা, কোন হাতে লাগাবে আমার এবার!
নিশ্চয়ই এসে বকবে আমাকে।
__________________________

দায়িত্ব! একই থেকে যায়, পরিবর্তন ঘটে কেবল মানুষের।
কাল আইশার মায়ের ছিলো, আজ আইশার, আগামীকাল আবার অন্য কারো…

লিখেছেনঃ তাসনুভা বিনতে হোসেইন

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment