একজন প্রতিভাবান যুবকের হিদায়াত প্রাপ্তি এবং মুরতাদ হয়ে যাওয়ার গল্প

Spread the love

এক. নাম ছিল আহমাদ আল উবায়দুল্লাহ(পলাশ)। [১]

সে ফেসবুকে নিয়মিত লিখত। সত্যকথন পেজে ওর আর্টিকেল বেশ কয়েকবার পাবলিশ হয়েছে। সমকালীন থেকে বের হ‌ওয়া ‘জবাব’ ব‌ইয়ে আরিফ ভাই, মিনার ভাই, রাফান ভাইদের সঙ্গে তার লেখাও ছাপা হয়েছে। এছাড়া তার ব্লগ ছিল। পেজ ছিল। প্রচুর লিখত সে। তার একটা ব‌ইও ছাপা হয়েছে। হিন্দু দর্শন এবং ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা বিষয়ক।

দুই.

আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, সদ্য কলেজ জীবন শুরু করা পলাশের মেধা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কথা বলে বুঝেছিলাম সে গোঁড়া মাদখালি। তবুও যোগাযোগ রেখে গেছি ওর ঈমান এবং অসাধারণ প্রতিভার কারণে। 

আমার সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয়, তখন মূলত হিন্দু দর্শনের সঙ্গে ইসলামের তুলনামূলক লেখালেখি করছে। মাঝেমাঝে স্বভাবসুলভ মাযহাব সংক্রান্ত পোস্ট করত। কিন্তু সেটা অনেক কম। আমার সঙ্গে ওর ফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপ ভালো যোগাযোগ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওর ব্যবহার ভালো ছিল না। আমি বহুবার অপমানিত হয়েছি। ভেবেছি আর যোগাযোগ করব না। কিন্তু ওর মেধা আমাকে বারবার ওর কাছে টেনে নিয়ে গেছে। আমি জানতাম মাদখালি হ‌ওয়ার কারণে সে ধীরে ধীরে উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সেজন্য বারবার অপমানিত হ‌ওয়া সত্যেও পলাশের সঙ্গে যোগাযোগটা বন্ধ করিনি।

আমি তখন ধীরে ধীরে দেওবন্দী চেতনার মধ্যে ঢুকছি। জামায়াতের বিভ্রান্তিগুলো তখন আমার কাছে স্পষ্ট। পাশাপাশি দেওবন্দী আলিমদের দলিল ও ইখলাস, আমল ও ইবাদত, আদল ও ইহসানে আমি অভিভূত। নিয়মিত তাদের দরসে বসছি, সোহবতে যাচ্ছি, প্রশ্ন করছি, পড়াশোনা করছি। রুহানিয়াত এবং আল্লাহর নৈকট্য নতুনভাবে অনুভব করতে পারছিলাম সেসময়। স্বাভাবিকভাবেই পলাশ জানত আমার অবস্থা। আর ঠিক সেগুলো নিয়ে তর্ক করত। দেওবন্দের আকিদায় এই সমস্যা, আমলে ওই সমস্যা, তারা সিফাত অস্বীকারকারী প্রভৃতি। আমিও তখন আমার নফস এবং জামায়াত থেকে প্রাপ্ত অপ্রয়োজনীয় তর্কে জড়ানোর অভ্যাস পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। ফলত পলাশের সঙ্গে মাঝেমধ্যে‌ই ঝগড়া শুরু হয়ে যেত। 

মোটকথা হল, পলাশ সবসময় ইলমি বিতর্ক শুরু করত। যদিও সে আরবিই পড়তে পারত না। 

তিন.

পলাশ মেধাবী ছিল। তার উস্তাদ ছিল গুগল আর পিডিএফ। যেহেতু তখন সে বাড়িতে থাকত, হার্ডকপি বা উস্তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশ্য ওর সঙ্গে কথা বলে আমার কখনোই মনে হয়নি উস্তাদের কাছে ইলম অর্জনের কোনো ইচ্ছে তার রয়েছে। তবে আমি সবসময় ওকে উদ্বুদ্ধ করতাম উস্তাদের কাছে ইলম অর্জনের জন্য।

পলাশ অহংকারী ছিল। বাংলা আর ইংরেজি ব‌ই পড়ে জটিল সব ইলমি বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করত। আরবি উচ্চারণ করতে না পারলেও তার ছিল মুজতাহিদ সুলভ ব্যক্তিত্ব। এমনভাবে জটিল সব ইলমি বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানাত, মনে হত সে বোধহয় বড়ো কোনো আলিম। অথচ তার সম্বল বলতে গুগল আর বাংলা-ইংরেজি কিতাব।

চার.

আলিমদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল না। দেওবন্দী আলিমদের প্রতি তার ব্যবহৃত ভাষাগুলো মনে পড়লে আজও খারাপ লাগে। এমনকি ওর নিজের ঘরানা, মাদখালি আলিমদের প্রতিও ওর ব্যবহার ভালো ছিল না। ওর মতের সঙ্গে যদি না মিলত, মাদখালি ধারার আলিমদের সম্পর্কেও এমন সব কথা বলব, যাতে আদবের ছিটেফোঁটাও থাকত না।

পাঁচ.

কিছুদিন পর পলাশকে আকিদা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করতে দেখলাম। সিফাতের মাসয়ালার মতো জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়ে তার পোস্টগুলো পড়লে মনে হত যেন দীর্ঘ সময় মুতালাআ পর্ব সেরে এসেছে। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা আমরা জানতাম। দুচারটে প্রশ্ন করলেই বুঝতাম আশাআরী-মাতুরিদি আকিদা সম্পর্কে তো সে জানেই না, এমনকি আছারি আকিদা সম্পর্কেও সে পুরোপুরি জানে না। 

আসলে উপমহাদেশের সুন্নি ঘরানাগুলোর মধ্যে জামায়াত এবং মাদখালি ঘরানার এটা একটা সমস্যা। তাদের মাধ্যমে যারা ঈমান আনে বা প্রাক্টিসিং হয়, তাদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বিতর্কে জড়ানোর প্রবনতা অনেক বেশি থাকে। যার নফস যত কলুষিত, সে তত বেশি উগ্র হয়ে ওঠে এই তার্কিক পরিবেশে। বলাবাহুল্য এইসব নবীন তার্কিকরা মূলত জাহিল হয়।

ছয়.

মুরতাদ হয়ে যাওয়ার কয়েকমাস আগে পলাশ খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইসলামের তুলনামূলক লেখালেখি শুরু করে। রাহুল ভাইদের বিতর্ক সভায়‌ও যেত দেখতাম। সম্ভবত সেই সময়ে সে কোনো খ্রিস্টান গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে। 

সেসময় সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা‌ও শুরু করেছিল। আমি তখন ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম মাদ্রাসায় পড়ার সংবাদ শুনে। অনেক দুআ এবং নসীহত করি সেসময় তাকে। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটাও অনেক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তখন। 

এরপর বেশ কিছুদিন ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন ফেসবুক পোস্ট দেখলাম। যেখানে সে মুরতাদ হ‌ওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পোস্টটা আমাকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। এখন তো কেবল একটাই চাওয়া, আল্লাহপাক পলাশকে আবার হিদায়াত দান করুন। 

| খোলাসা |

আমি বহুবার ভেবেছি ওর পথভ্রষ্টতার কথা। কেন সে মুরতাদ হল? প্রশ্নটার উত্তর আমায় বারংবার ভাবিয়েছে। এবং কিছু কিছু কার্যকারণ সম্পর্কের খোঁজ পেয়েছি। যেগুলো এক সূত্রে গাঁথলে হয়তো পুরো চিত্রটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। 

ক) তার উস্তাদ ছিল গুগল এবং পিডিএফ। কোনো আলিমের সোহবতে সে সাধারণত যেত না। এটা একটা বড়ো ফিতনা। কিতাব আর ইন্টারনেট ইলম অর্জনে সহযোগী হতে পারে। কিন্তু উস্তাদ হতে পারে না। আমাদের সালাফ, আমাদের ইমামরা কিতাবকে উস্তাদ বানাতে বারবার নিষেধ করে গেছেন। ইমাম আহমাদের উস্তাদ ইমাম শাফিঈ রহ. তো কড়া ভাষায় বলেছেন, “কিতাবের পাতা থেকে যারা ফিকহ শিখে, তারা শরিয়তের আহকামগুলোকে নষ্ট করে ফেলে”। (২)

ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য যে কতটা বাস্তব, তা আমি পলাশের মধ্যে দেখেছি। এমন হাস্যকর মতামত সে দিত, ভাবলে অবাক লাগে। একবার সে আমায় বলল, আগের যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না, সেজন্য জি/হা/দের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া হত। এখন যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত, স্যোশাল মিডিয়া সহ নানান মাধ্যমে কোনো অঞ্চলে সশরীরে না পৌঁছেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো যায়, সেজন্য এখন আর জি/হা/দের প্রয়োজন নেই। পলাশের ইলমি হালাত এরকম বেহাল ছিল।

খ) পলাশ আরবি পড়তে পারত না। অথচ দ্বীনের জটিল সব বিষয়ে ইলমি আলাপের পাশাপাশি নাস্তিক-মুশরিক-আহলে কিতাবদের খণ্ডন করার চেষ্টা করত। যে আরবি পারে না, যার দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান নেই, যার উস্তাদ গুগল এবং কিতাব, সে যখন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ময়দানে নেমে যায়, তখন তার কী অবস্থা হয় সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল পলাশ। সে হিন্দু দর্শন এবং ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা করত, নাস্তিক্যবাদের জবাব দিত, আহলে কিতাবদের রদ করত, মাযহাব মানা না মানা বিষয়ে আলোচনা করত, সিফাতের সূক্ষ্ম মাসয়ালা নিয়ে লেখালেখি করত। ইলম অর্জনের আগেই যে এতগুলো বিপজ্জনক ময়দানে নেমে যায়, ঈমান আনার পরেও কুফরের গর্তে তার হারিয়ে যাওয়া তখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না।

গ) পলাশের আদব ছিল না। ভিন্ন মতের আলিম কিংবা সাধারণ মুসলিমের প্রতি সে সম্মান দেখাত না। সবার দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াত। তাচ্ছিল্য করত। নিজস্ব ঘরানার আলিমদের প্রতিও ওকে কখনও তেমন শ্রদ্ধাশীল পাইনি। এটা অনেক বড়ো একটা সমস্যা। আলিমদের যারা শ্রদ্ধা করে না, যারা সবসময় অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়, তাদের দ্বীন সন্দেহজনক। 

তাছাড়া একজন মুমিন দ্বীনের প্রতি যতটা আবেগী থাকে, পলাশের মধ্যে তার সামান্য নিদর্শন‌ও আমি কখনও পাইনি। সবসময় সে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে থাকত। এটা কোনো ছোটখাটো সমস্যা নয়। অতিরিক্ত তর্কবিতর্ক মুমিনের অন্তরকে মেরে ফেলে। আমার ধারণা ওর অন্তর নষ্ট হয়ে গেছিল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাঃ প্রতি মহব্বত, আবেগ, শ্রদ্ধা যদি অন্তরে বেঁচে থাকত, এভাবে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

| শেষ কথা |

নিছক স্মৃতিচারণা কিংবা পলাশ কত খারাপ ছিল সেটা জানানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি এমন একজন মুমিনকে কাছ থেকে দেখেছি, যে মুরতাদ হয়ে গেছে। আর কোনো মুমিনের সঙ্গে যেন এমন না ঘটে, সে উদ্দেশ্যেই এই লেখা। আমি চেষ্টা করেছি ওর সমস্যাগুলো আপনাদেরকে জানানো। লেখাটা পড়ার পর মনে হতে পারে আমি কেবল খারাপ দিকগুলোই বললাম। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মুর/তাদের গুণ বর্ণনা মুমিনের শান নয়। তাছাড়া তার গুণ জেনে আমাদের লাভ কী? বরং যে সম্ভাব্য কারণগুলো তাকে কুফরের গর্তে ফেলে দিয়েছে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সচেতন হ‌ওয়া উচিত। 

আমাদের অনেকের মধ্যেই কিন্তু পলাশের দোষগুলো কমবেশি রয়েছে। আমাদের অনেকের‌ই উস্তাদ নেই। আমাদের অনেকের‌ই ফরজ ইলম নেই, অথচ অনলাইনে অফলাইনে তর্কবিতর্ক করে সময় পার করি। আমরা অনেকেই আলিমদের শ্রদ্ধা করি না। মুমিনদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াই। অত‌এব এখন‌ই আমাদের সাবধান হ‌ওয়া উচিত। কে বলতে পারে আমাদের পা পিছলে যাবে না? কে বলতে পারে মহামূল্যবান ঈমান আমরা হারিয়ে ফেলব না? ঈমান আনা কঠিন। ঈমান টিকিয়ে রাখা আর‌ও কঠিন। রাসূলুল্লাহর হাদীস স্মরণ রাখা উচিত, যেখানে বলা হচ্ছে শেষ যুগে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন হবে। (৩)

| তথ্যসূত্র |

১) আহমদ আল উবাইদুল্লাহর পূর্ব নাম পলাশ নয়। অনলাইনে প্রাইভেসির কারণে সে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিত না। কারণ তার পরিবার থেকে সে ক্ষতির আশংকা করত। আমরাও তাই প্রকৃত নাম গোপন রাখছি।

২) তাযকিরাতুস সামি ওয়াল মুতাকাল্লিম, পৃষ্ঠা-৮৭

৩) তিরমিজি, ২২৬০

লিখেছেনঃ আতিক আব্দুল্লাহ (আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করেন)।

About the author
Fawzul Kabir

Leave a Comment