সেলিব্রেটিদের নিয়ে আমাদের সাধারণ জনগনের উৎসাহ সাধারণত বেশিই থাকে। তাদের নিয়মিত জীবনের কাজ, ফ্যামিলি, হাবিজাবি আদ্যপান্ত- খুঁটিনাটি যতকিছু আছে সব জানা থাকা চাইই-চাই।
বর্তমানে দ্বীনের জন্য যারা কাজ করে, তাদের নিয়েও কখনো কখনো আমরা মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলি। এক পর্যায়ে ভালো-মন্দ বাছ-বিছারের ক্ষমতাও হারিয়ে যায়। কোন এক সময় তারাও এই যশ-খ্যাতি উপভোগ করতে থাকে।
আপনাদের আজ একটা গল্প শোনাই। একজন সেলিব্রেটির গল্প। উহু! এই জমানার সেলিব্রেটি না। বরং এই পৃথিবীর সেলিব্রেটিও তিনি নন। তার জনপ্রিয়তা তো অন্য জগতে। তার আলোচনা তো করেন আসমানের বাসিন্দারা। মাটির মানুষদের কাছে অজানা- সেই গুপ্ত সেলিব্রেটির নাম হলো, “উওয়াইস আল-কারনি।”
[১]
সাহাবিরা রাসুল (সা:) কে ঘিরে আছেন। রাসুলের চারিপাশে উৎসুক জনতা কিছু মাত্র কথা শোনার জন্যে নিজের জীবন দিতেও যেন প্রস্তুত। তিনি যে আল্লাহ তায়ালার বার্তাবাহক। তার দেখানো পথেই যে আছে সফলতা। বাকি সব দুনিয়া তো তুচ্ছ! তারা জানতে চায়, কে আল্লাহ তায়ালা কাছে সর্বাধিক প্রিয়?
রাসুল (সা:)ও তার পবিত্র জবান দিয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে আসল প্রিয় বান্দার বর্ণনা দিতে লাগলেন। (আবু হুরায়রা (রা:) পরবর্তীতে এই হাদিসে কুদসিটি বর্ণনা করে আমাদেকে জানার সুযোগ দেন)।
“আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন এমন বান্দাদের যারা খোদাভীরু, যাদের অন্তর পরিশুদ্ধ, তারা নিজেদেরকে গোপন রাখে, তাদের মুখমণ্ডল ধুলোমলিন, যাদের চুল এলোমেলো, যাদের পেট খালি, তারা শাসকের সাথে দেখা করতে চাইলে অনুমতি পায় না, তারা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে ফিরিয়ে দেয়া হয়, তারা দুনিয়ার কিছু ত্যাগ করলে কখনোই তার অভাব বোধ করে না, তারা কোথাও থেকে বের হয়ে গেলে কেউ লক্ষ করে না, তারা অসুস্থ হলে কেউ দেখতে আসে না, এবং মারা গেলে কবর পর্যন্ত পৌঁছাতেও কেউ আসে না।”
এমন ব্যক্তির বর্ণনা শুনে সাহাবিরাও সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করার জন্যে উৎসাহবোধ করলেন। কিন্তু এমন ব্যক্তি তো পাওয়া বিরল। তাকে কিভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে? তারা রাসুল (সা:)কে জিজ্ঞেস করলেন,
“ইয়া রাসুলুল্লাহ! এরকম ব্যক্তিকে আমরা কোথায় খুঁজে পাই?”
রাসুল (সা:) জবাব দিলেন, “উওয়াইস আল-কারনি হচ্ছে এমনই এক ব্যক্তি।”
সবার মনেই তখন এক প্রশ্ন উওয়াইস আল-কারনি কে? তাকে কিভাবে চিনতে পারবো?
রাসুল তখন তার গঠন এবং ইখলাস,আমলের বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে বললেন, “তার বাম কাঁধের নীচে সাদা দাগ আছে। আখেরাতের দিন তাকে সুপারিশ করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিবেন। তার সুপারিশের বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা রবীয়া ও মুজার গোত্রের ঢের লোকসংখ্যার সমান মানুষকে ক্ষমা করে দিবেন।”
রাসুল (সা:) এরপর আলী (রা:) এবং উমর (রা:)কে সম্বোধন করে বললেন, ” হে আলী, হে ওমর! তোমরা যদি কখনো তার দেখা পাও, তাহলে তাকে বলো, তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন।” [১]
এই কাহিনীর বহুদিন পেরিয়ে গেছে। দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে, সপ্তাহ পেরিয়ে বছর চলে গেছে। রাসুল এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, আবু বকর (রা:)-ও বিদায় নিলেন। কিন্তু ওমর ও আলী (রা:) তাকে তালাশ করা ছাড়েন নি। আমরা হলে হয়তো এতদিনে কথাগুলো ভুলে খেয়ে অন্য ধান্দা করতাম।
এ জন্যই হয়তো আমরা সেখানে নেই। এ জন্যই আজ তারা ওমর এবং আলী (রা:)।
[২]
প্রতিবারেই ইয়েমেন থেকে আসা কাফেলাকে আমিরুল মুমিন এক ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কোনবারই কেউ উত্তর দিতে পারে না। এবারেও তিনি তার ব্যতিক্রম করলেন না। ইয়েমেন থেকে মদিনা হয়ে ইরাকের দিকে যাবে কাফেলাটা। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যার নাম উওয়াইস?”
তবে এবারের ঘটনা ব্যতিক্রম হলো। ভীড় ঠেলে এক বৃদ্ধ দাঁড়ালেন। ধীর কণ্ঠে উমর (রা:) কে বললেন, “আপনি কোন উওয়াইসে কথা জিজ্ঞেস করছেন তা তো জানিনা, তবে আমার ভাইয়ের ছেলের নাম উওয়াইস। কিন্তু সে তো তেমন কেউই না। এমনকি সে তো এতই গরীব ও বিনয়ী যে আপনার তাকে চিনার কথা না। সে আমাদের উটগুলো দেখে-টেখে রাখে। আমাদের মাঝেও তার বিশেষ কোন স্থান নেই।”
বৃদ্ধের কথা শুনে উমর (রা:) তার বিষয়ে আরও জানতে চাইলে বৃদ্ধ অবাক চোখে প্রশ্ন ছুড়েন,
“হে আমিরুল মুমিনিন! কেন তার ব্যপারে এত জিজ্ঞাসা? আল্লাহ কসম! এত বোকা আর হতদরিদ্র আমাদের মধ্যে আর কেউই নেই।”
উমর (রা:) এর জন্যে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি কান্নাবিজোড় স্বরে বলেন, “তুমি হতদরিদ্র, সে না। কারণ রাসুল (সা:) তার সম্পর্কে বলেছিলেন, তার সুপারিশে রবীয়া ও মুজার গোত্রের বিপুল পরিমান মানুষের গুনাহও মাফ করে দিবেন।”
উমর এবং আলী (রা:) বৃদ্ধের থেকে খোঁজ নিয়ে আরাফার চূড়ায় গেলেন। সেখানে গাছের নীচে ইবাদত করা অবস্থায় উওয়াইসকে দেখতে পেলেন। তার চারিপাশে উট ঘোরাফেরা করছিল।
– আসসালমু আলাইকুম।
ইবাদত শেষ করে উওয়াইস শান্তভাবে বললেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
– কে তুমি?
– আমি উট দেখাশোনা করি আর একটি গোত্রের জন্যে কাজ করি।
– পশু পালন কিংবা কোন গোত্রের কাজের লোক সেসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনি। তোমার নাম কী তা জানতে চাচ্ছিলাম আসলে।
– উওয়াইস শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন “আব্দুল্লাহ।”
– তোমাকে কি নামে সম্বোধন করে সেটা জানতে চাচ্ছিলাম। আমরা সবাই-ই তো আব্দুল্লাহ।
– তোমরা আমার কাছে কী চাও?- উওয়াইসের কণ্ঠে এবার জিজ্ঞাসা।
উমর এবং আলী (রা:) রাসুলের বাণী তার নিকট খুলে বললেন। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী উওয়াইসও তার বাম কাঁধ খুলে দেখালে সেখানে স্পষ্ট সাদা দাগ দেখা যায়। সন্দেহের আর কোন বিন্দুই অবশিষ্ট থাকেনা। এই সেই ব্যক্তি, যার বিষয়ে রাসুল (সা:) এত এত প্রশংসা করেছিলেন। দীর্ঘ দশ বছর খুঁজেও যাকে পাওয়া যায়নি কোথাও। আজ সে উমর (রা:) এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নিতান্তই সাধারণ এক উটপালক, উওয়াইস আল-কারনি।
[৩]
ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। উমর এবং আলী (রা:) তাকে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কাছে দোআ চাইয়ে নিয়েছিলেন। চিন্তা করা যায়? আমিরুল মুমিনিন! অর্ধ জাহানের বাদশাহ! নিতান্ত এক উটপালকের কাছে বলছে আল্লাহ তায়ালার নিকট যেন দোআ করে দেয়।
আজ তো আমদের এমন অবস্থা হয়েছে যে, ফেসবুকে দু, একটা কথা লিখলেই নিজেকে বিশাল আল্লাহ ওয়ালা মনে করে ফেলি। সাধারণদের লেখা তখন লাগে দুধভাত। দেখা যায়, সেলিব্রেটি ছাড়া আর কারো সাথে বন্ধুত্বও যেন জমেই না।
যাইহোক, উমর (রা:) তখন তাকে আনন্দিতভাবে বললেন, তুমি এইকালে এবং ঐকালে দুই কালেই আমার বন্ধু।
কিন্তু উওয়াইস তো জানতেন, এইজীবনে উমরের বন্ধু মানেই সুনাম আর সচ্ছলতা। তিনি বন্ধুত্ব গ্রহণ করলেও খুব সুকৌশলে বিনয়ের সাথে দুনিয়ার সুনাম প্রত্যাখান করলেন। যেমন তিনি ছিলেন, ঠিক তেমনই থাকতে চাইলেন। একদম সাদা-সিধা, ছিমছাম।
এই ঘটনার পর উওয়াইস কুফায় গিয়ে সাধারণ জীবন কাটাতে থাকলেন। কুফা থেকে এক ব্যক্তি মদিনায় আসলে উমর (রা:) তাকে উওয়াইসের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। সেই ব্যক্তির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কারণ নিতান্তই সাধারণ, হতদরিদ্র এক ব্যক্তির সম্পর্কে আমিরুল মুমিনিন জিজ্ঞেস করবেন এই বিষয়টি অবিশ্বাস্যই বটে!
উমর (রা:) বললেন, “যদি তুমি তার দেখা পাও তাহলে তাকে বলো তোমার জন্যে দোআ করতে। কারণ রাসুল তাকে দিয়ে আমার মাগফিরাতের দোআ করতে বলেছিলেন।”
সেই লোক কুফায় গিয়ে উওয়াইসের সাথে দেখা করেন। তার জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দোআ চাইলে উওয়াইস বুঝে ফেলেন যে উমর (রা:) তাকে তার সম্পর্কে বলেছেন। সেই ব্যক্তির জন্য উওয়াইস দোআ করে দেন।
কিন্তু বিষয়টা সারা কুফায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। একে একে সবাই উওয়াইসের সম্পর্কে জেনে যায়। মানুষজন তখন আল্লাহর দরবারে মাফ করিয়ে নিতে ভীড় করতে থাকেন। কিন্তু তারা এসে দেখেন উওয়াইসের ঘর খালি পড়ে আছে। ঘরে ছিটা ফোটাও নেই, উওয়াইসও নেই। দুনিয়ার যশ-খ্যাতি ছেড়ে তিনি আল্লাহর জন্য নিরালায় কোথাও চলে গেছেন। কে জানে, কোথায় গেছেন?
একমাত্র আল্লাহর জন্যই বেঁচেছেন। এবং তার জন্যই মরেছেন। ইখলাসের সাদা চাদরে নিজেকে জড়িয়ে ধরেছেন। [২]
[৪]
উওয়াইস আল-কারনি তাবেয়ি ছিলেন। এক বর্ণনায় আছে মায়ের দেখভাল করার জন্যে তিনি রাসুল (সা:) এর সাথে দেখা করার জন্যেও যেতে পারেন নি। তার মতো এমন কত কত না জানি মানুষ লুকিয়ে আছেন যাদের আমরা চিনি না, জানি না, অথচ তাদের মর্যাদা কত উঁচুতে।
দাউদ ইবনে আবি হিন্দ চল্লিশ বছর যাবত সিয়াম রেখেছিলেন, অথচ তাঁর স্ত্রী সে বিষয়ে জানতেনও না। আয়্যুব সাখতিয়ানি (রাহ:) সারারাত নামাজ পড়তেন আর ফজরের কিছুক্ষন আগে জোরে তেলাওয়াত করতেন যেন লোকেরা ভাবে তিনি মাত্র ঘুম থেকে জেগেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মোবাক (রহ:)-ও ইবাদতের বিষয়ে খুবই সচেতন এবং ইখলাসওয়ালা ছিলেন।
কেয়ামতের ময়দানে এসকল লোক চাঁদনি রাতের চাঁদের মতো ফুটে উঠবে। দেখা যাবে আমার পাশের বাড়ির মেয়েও এরমধ্যে আছে, অথচ তাকে আমি গণনাতেই ধরতাম না।
আখেরাতের সেলিব্রেটিদের তো কথাই ভিন্ন হয়, তাইনা? তাদের মর্যাদাই আলাদা।
রেফারেন্স:
[১] (সহীহ মুসলিম, হাদিস:২৫৪২ বাব: ফাদায়েলে উওয়াইসিন)
[২] (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪/৫১৯, তাবাকাতে ইবনে সাদ: ৬/১৬১, তাহযিবুত তাহযিব, ১/৩৮৬)
লেখিকাঃ খাদিজা রায়হানা।